গৌরনদী উপজেলার পটভূমি
‘‘গৌরনদী’’ র নামকরন
বরিশাল জেলার এতিহ্যবাহী ও সমৃদ্ধ একটি উপজেলার নাম গৌরনদী। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে এ উপজেলার রাজনৈতিক ও সামাজিক গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। ‘‘গৌরনদী’’ র নামকরন নিয়ে সুনিদৃষ্ট কোন লিখিত ইতিহাস নেই। ‘‘গৌরনদী’’র নামকরন সম্পর্কে প্রবীনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যই মানুষ জানে। এক সময় গৌরনদী সদরসহ বৃহত্তর গৌরনদী ( আগৈলঝাড়াসহ) র গোটা এলাকা ছিল নদী দ্বারা বেষ্ঠিত। গৌরনদীর পূর্বাঞ্চলে রয়েছে আuঁড়য়াল নদী। আর আড়িঁয়াল খার শাখা নদী হচ্ছে পালরদী নদী। এক সময় পালরদী ছিল স্রোতস্বীনি নদী । গৌরনদীর প্রবীনজন ও ইতিহাসবিদদের সংজ্ঞা মতে, আড়িঁয়াল খাঁ নদীর শাখা নদী পালরদী নদীকে ঘিরেই গৌরনদীর নামকরন করা হয়। এ নদীর সাথে গৌরনদীর সংযুক্ততা রয়েছে। আড়িঁয়াল খাঁ নদীর শাখা নদী পালরদী নদীর প্রবাহমান পানির রং ছিল গৌড় বর্নের। সে অনুসারে গৌড়্ওবং নদী যুক্ত হয়ে ‘‘গৌরনদী’’ র নামকরন করা হয়েছে। গৌরনদী কলেজের প্রতিষ্ঠতা অধ্যক্ষ মোঃ তমিজ উদ্দিন ও গৌরনদীর ইতিহাস লেখক প্রফেসর মোসলেম উদ্দিন সিকদারের একাধিক লেখায় গৌরনদীর নামকরনের আদী ইতিহাস হিসেবে এ তথ্যের উল্লেখ্য রয়েছে। বরিশালের ইতিহাস লেখক সিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ তার বইয়ে নদীর নামানুসারে গৌরনদীর নামকরনের কথা উল্লেখ করেছেন।
ভৌগলিক পরিচিতি
Geographical Information for Gaurnadi
Place name: Gaurnadi
Latitude: 22° 58' 14" N
Longitude: 90° 14' 37" E
Feature description: town
Area/state: Barisal
Population range of place: is between 1000 and 2000
Other alternative names: Gournadi
Country: Bangladesh
Country ISO code: BD
ইউনিয়নসমূহ
সরিকল ইউনিয়ন
বাটাজোর ইউনিয়ন
মাহিলাড়া ইউনিয়ন
নলচিড়া ইউনিয়ন
চাঁদশীঁ ইউনিয়ন
বার্থী ইউনিয়ন
খাঞ্জাপুর ইউনিয়ন
খেলাধুলা ও বিনোদন
প্রাচীনকাল থেকেই গৌরনদী উপজেলা জনেগাষ্ঠী ক্রীড়ামোদী। এখানে প্রতিবছরই বিভিন্ন টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। এখানকার জনপ্রিয় খেলার মধ্যে বর্তমানে ক্রিকেট ও ফুটবলের আধিপত্য দেখা গেলেও অন্যান্য খেলাও পিছিয়ে নেই। গৌরনদী বেশ কয়েকটি খেলার মাঠ রয়েছে। এর মধ্যে গৌরনদী সরকারী কলেজ খেলার মাঠ , বাটাজোর হাই স্কুল মাঠ, মাহিলাড়া ডিগ্রী কলেজ মাঠ, গৌরনদী হাই স্কুল -শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। প্রতি বছর এসব মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট সহ নানান প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে গৌরনদী
৭১’র মুক্তিযুদ্ধে গৌরনদীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল সাধারণ নির্বাচনের পরে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে যখনই টালবাহান শুরু হল। তখনই সমগ্র বাঙালী জাতি বুঝতে পারল বাঙালীর তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া বিকল্প নেই। বাঙালী জাতীর একমাত্র অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের একটি নির্দেশের অপেক্ষা রয়েছে সাত কোটি বাঙালী। প্রিয় নেতা কখন, স্বাধীনতার জন্য জনযুদ্ধের ডাক দেন। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান লাখো লাখো জনতায় সমগ্র মাঠটি কানায় কানায় পরিপূর্ণ। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত। মুক্তিকামী মানুষের শুধু একটিই আবেগ ছিল প্রিয় নেতা কখন নির্দেশ দিবে। অবশেষে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাক ‘‘এ বারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’’ ‘‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’’ ঘরে ঘরে দুর্গ করে তোল । শত্রুর মোকাবেলা করে এ দেশকে স্বাধীনু করতে হবে। মহান নেতার এই ভাষণ প্রতিটি মুক্তিকামী জনতার মনে দীক্ষমন্ত্রের মতো কাজ করতে লাগলো। ৭১’র ২৫ মার্চ ঘুমন্ত মানুষের উপর রাতের অন্ধকারে পশ্চিম পাকিস্তানী কাপুরুষ শাসক গোষ্ঠির অতর্কিত হামলা।
বন্ধবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা পত্রটি ই-পি-আরের ওয়ারলেচ যোগে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে আওয়ামীলীগ প্রচার হওয়ার সাথে সাথে যুদ্বের জন্য গৌরনদীর মুক্তিকামী মানুষ। বরিশাল অঞ্চলে তখনও পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেষ মজিবুর রহমানের মন্ত্রী সভার সদস্য ও কৃষককুলের নয়নমনি আব্দুর রব সেরনিয়াবাদের সার্বিক সহযোগিতায় গৌরনদী কলেজ মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন শুরুর পদক্ষেপ নেয়া হয়। গৌরনদী থানা থেকে আনা ৩০টি রাইফেল দিয়ে শুরু হল ট্রেনিং। গৌরনদী কলেজ মাঠে ট্রেনিং কমান্ডার সাইলেঞ্জার কাশেমের উদ্বুদ্ধকরন বক্তৃতা যুব সমাজকে উৎসাহিত করেছিল। ২৫শে এপ্রিল ১৯৭১ হঠাৎ করে বেলা আনুমানিক ১১টা দিকে লক্ষ্মন দাস সার্কাসের মালিক অরুন দাস খবর দেয় মাদারীপুর থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাজোয়া যান নিয়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা করছে। গৌরনদীর মুক্তিযোদ্ধারা খবর পাওয়ার সাথে সাথে পাক সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্ত্ততি নিতে শুরু করে। বেইজ কমান্ডার সৈয়দ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ডা: আ.ন.ম হাকিম বোহরামের নেতৃত্বে ৩০ জন যোদ্ধা ভূরগাটা গিয়ে পাক হানাদার প্রতিরোধ করার জন্য পরিকল্পনা নিয়ে ভূরঘাটার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়। টরকীর কটকস্থল পৌছা মাত্রই দেখতে তারা দেখতে পান পাকিস্তানী হায়নাদের সাজোয়াযান এসে গেছে। সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধার দল বিভক্ত হয়ে চারদিক থেকে পজিশন নেয়। পাক হায়নাদের গাড়ী পৌঁছা মাত্রই যোদ্ধারা হায়নাদের উপর গুলি চালালে শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ । ২২ গাড়ী সেনাবাহিনীর সাথে মাত্র ৬২ জন মুক্তিযোদ্ধা হালকা অস্ত্র দিয়ে প্রায় তিন চার ঘণ্টা যুদ্ধ করে অথ্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক সেনাবাহিনীর সাথে। তাতে চার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং আটজন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিহত হন। যে চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তারা হলেন গৈলার আলাউদ্দীন বক্স (আলা বক্স)। তার সমাধি করা হয় গৈলা হাইস্কুলেল দক্ষিণ পাশে। বাটাজোর দেওপাড়ার মোক্তার হোসেন। তার সমাধি করা হয় ধানডোবা বড়বাড়ী বোর্ড স্কুলের পিছনের বাড়ীর একটি বাঁশ বাগানে। নাঠৈ গ্রামের সৈয়দ হাশেম আলী । তার সমাধি করা হয় নাঠৈ ঈদগাহ ময়দানের পাশে। চাঁদশী গ্রামের পরিমল মন্ডল। তার সমাধি করা হয় চাঁদশী মন্ডল বাড়ীতে । এটা ছিল গৌরনদীর তথা বরিশালের প্রথম পাক হানাদার প্রতিরোধ ও সম্মুখ যুদ্ধ। ২৫ এপ্রিলের পর থেকেই সমস্ত বরিশালে যুদ্ধ ছড়িয়ে পরে। গৌরনদীর বিভিন্ন জায়গায় রাজাকার, পীচ কমিটি, লুটারও সমস্ত স্বাধীনতা বিরোধিরা উলাসিত। পাকিস্তানী সেনাদের এই হত্যাযজ্ঞে তারা বেপারোয়া হয়ে উঠল বাংলাদেশের সব জায়গার মতো। গৌরনদী উপজেলার রাজাকার, পীচকমিটি, স্বাধীনতা বিরোধীরা গৌরনদীর বিভিন্ন ইউনিয়ন, গ্রামগঞ্জে নারী হত্যা, শিশু হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট শুরু করে। ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল বাটাজোরে ইউনিয়নের প্রথম শহীদ হন ইউপি চেয়ারম্যান সোনামদ্দিন মিঞা। এছাড়া ১৮ মে ১৯৭১ স্থানীয় রাজাকার মানিক রাঢ়ী ও খাদেম মিলিটারীর সহায়তায় বাটাজোর ইউয়িনের হরহর গ্রামের বাড়ৈ পাড়ায় চালানো হয় হত্যাযজ্ঞ। শিশু থেকে বৃদ্ধকে পাকসেনারা ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এ এদেশ শত্রু মুক্ত হলেও গৌরনদী মুক্ত হয় ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১। হোসনাবাদের নিজাম উদ্দিন আকনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ও আবুল হাসানাত আবদুলাহর নেতৃত্বে মুজিববাহিনী যখন পশ্চিমা হায়নাদের কজ্বা করে এনেছিল তখন ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান হানাদারা মিত্রবাহিনীর মেজর ডি.সি দাসের নিকট আত্মসমর্পন করেন। এই আত্মসমর্থনের মধ্যে ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ গৌরনদী শত্রু মুক্ত হয়। গৌরনদীর আকাশে উদিত হয় স্বাধীনতার লাল সূর্য্য।