বনরূপা বাজারের একদিকে কর্ণফুলী নদী ও কাপ্তাই হ্রদ, অন্যদিকে বাজার, সরকারি অফিস ও পাহাড়। তাই বনরূপাকে জল পাহাড়ের বাজার বললেও ভুল হয়না। রাঙ্গামাটির প্রধান সড়কের ওপরই বনরূপা বাজারের অবস্থান। রাঙ্গামাটিতে আরও দুটি বড় বাজার আছে- রিজার্ভ বাজার ও তবলছড়ি বাজার। রিজার্ভ বাজারটা অনেক পুরনো, ওখান থেকেই রাঙ্গামাটির বরকল, ছোট হরিণা, বড় হরিণা, লংগদু প্রভৃতি স্থানে যাওয়ার লঞ্চ ছাড়ে। বনরূপা বাজারটা নতুনভাবে গড়ে উঠেছে। তবে উপজাতিদের জন্য বনরূপা বাজারে রয়েছে একটা বিশেষ জায়গা যেখানে তাদের ঐতিহ্যের খাদ্যসামগ্রী ও পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হয়। এ ছাড়াও খুব ভোরে উপজাতিরা তাদের কাাঁচামাল বেচাকেনা করে কলেজ বাজারে।
সকালে চকিতে বাজারের পায়ে চলা পথ দিয়ে হেঁটে চলে গিয়েছিলাম সমতা ঘাট পর্যন্ত। ওটাই এ বাজারের প্রধান পোর্ট, বলা যায় কাপ্তাই হ্রদ আর কর্ণফুলী নদী দিয়ে নৌকায় পণ্য আনা নেয়ার প্রধান স্থান। হাটের দিন বুধবার। সেদিন ওখানে শত শত নৌকা পণ্য বোঝাই করে এসে ভিড়ে। সমতা ঘাটে তাই কুলীদের হাঁকডাক, হাতেঠেলা গাড়ির ব্যস্ততা। সরু রাস্তার দুধারে নানা রকমের দোকানপাট। সেসব দোকানের সামনে তরিতরকারি নিয়ে বসে আছে উপজাতি মেয়েরা। ছেলেরাও আছে, তবে সে সংখ্যা ওদের তুলনায় খুব কম। পাহাড়ি মেয়েরা সাত সকালে বনরূপা বাজারে নিয়ে এসেছে নানা রকমের ইথনিক ফুড তথা উপজাতীয়দের পছন্দের লতাপাতা, শাক সবজি, মাছ, শুটকি, নাপ্পি, তামাক, আখ, খড়ি ইত্যাদি। ক্রেতা-বিক্রেতাদের অধিকাংশই উপজাতীয়। বিক্রেতা উপজাতীয়রা সবাই চাকমা সম্প্রদায়ের। ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-বুড়ি সবাই বাঁশের চোঙ্গায় তৈরি এক রকমের হুক্কায় মাটির কলকি লাগিয়ে তামাক টানছে। ওদের ভাষায় ওটা হলো ডাব্বা। এ দৃশ্য দেখে সহজেই চাকমাদের তামাক সেবনের অভ্যেস সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
বনরূপা বাজারের কাঁচা বাজারের গলিটার মুখে অল্প কিছু শুটকি মাছ আর ফলের দোকান। তাজা মাছের দোকান নেই। কাপ্তাই হ্রদে মে-জুন, এ দুমাস মাছ ধরার ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বাজারও প্রায় মাছশূণ্য। স্থানীয় কিছু জলাশয় থেকে মাঝে মধ্যে কিছু ছোট মাছ বাজারে ওঠে। তাই ক্রেতারা এ সময় শুটকী মাছের ওপরই বেশী ভরসা করে। তবে চট্টগ্রাম ও ফেণী থেকে এ সময়টায় সিলভার কার্প, তেলাপিয়া বা নাইলোটিকা, কমন কার্প, ভোলা, চিংড়ি এবং বরফ দেয়া কিছু সাগরের মাছ যায় ওখানে। ফল বলতে পাহাড়ি কলা, আনারস, পেয়ারা, আম, লটকন আর নানা জাতের লেবু। পাহাড়ি কলা পার্বত্য অঞ্চলে ‘বাংলা কলা’ নামে পরিচিত। ওটা আসলে সমতলের ঠুঁটে বা দুধসাগর কলা। আছে টক-মিষ্টি স্বাদের চাম্পা কলা। পাকা চাম্পা কলার শাঁসের রঙ ঘন করে জ্বাল দেয়া দুধের মতো। তবে রাঙ্গামাটির বনরূপা বাজারের আর এক বিশেষত্ব ‘আগুনে কলা’। আগুনের মতো লাল পাকা কলার খোসার রঙ। কেতাবী ভাষায় ওই কলার নাম ‘অগ্নিশ্বর কলা’। কোন কোন পাহাড়ি বলে সিন্দুরে কলা বা লালকেল। সাগর কলার মতোই বড় ও আকৃতিও তেমনি, খোসা পুরু। তবে সাগর কলার মতো অতো সুস্বাদু নয়। দেখতে মনবাহারি। বাংলা কলা ওখানে খুবই জনপ্রিয়। তাই দামটাও বেশী। এক ডজন বাংলা কলার দাম পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত হাঁকতে দেখলাম। আনারস বেশ সস্তা, মিষ্টিও বটে। ছোট ছোট মিষ্টি স্বাদের সে আনারসকে আদর করে লোকেরা ডাকে ‘বেবী কুইন বা হানি কুইন’ নামে, দাম এক হালি ১০ থেকে ২০ টাকা।
গলি দিয়ে একটু একটু করে এগুতেই দেখলাম সেদ্ধ করা পশম ছিলা মুরগি নিয়ে বসে আছে বিক্রেতারা। পাশাপাশি জুমে উৎপাদিত নানা রকমের চাল। তিন রকমের বিন্নি চাল চোখে পড়ল- লাল বিন্নি, সাদা বিন্নি ও কালো বিন্নি। লাল বিন্নিকে ওরা বলে বান্দরনখ বিন্নি ও সাদা বিন্নিকে বলে লক্ষ্মীবিন্নি। কালো বিন্নিকে বলে লংকাপোড়া বিন্নি। বিন্নি চালকে কেউ বলে বিনি চাল। চালগুলোতে আলাদা এক ধরনের সুবাস আছে। তা ছাড়া ওসব চালের ভাত বেশ আঠালো। অনেকটা জাপান ও ভিয়েতনামের স্টিকি রাইসের মতো। জানা গেল ওটাই জুমের সেরা চাল। দামেও সেরা, প্রতি কেজি বিন্নি চালের দাম ৪৫ টাকা। বাঁশের তৈরি এক ধরনের বিশেষ ঝুড়িতে চাল ও অন্যান্য পণ্য নিয়ে বিক্রি করতে বসেছে বিক্রেতারা। এসব ঝুড়ি স্থানীয় ভাষায় লাই নামে পরিচিত।
চালের দোকান পেরিয়ে এবার গিয়ে পড়লাম শাক সবজির দোকানে। পথের উপর একের পর এক অনেকগুলো শাক সবজির দোকান নিয়ে বসেছে চাকমা মেয়েরা। পরনে উজ্জ্বল রঙের পিনন ও ব্লাউজ, ওড়না। হাতে তামাক খাওয়ার ডাব্বা। তুলসী পাতার মতো এক ধরনের পাতা, ডগাগুলো শাকের মতো আঁটি বেঁধে বিক্রি হচ্ছে। নাম জানতে চাইলেই কেউ বললো ‘সাভরাঙ’ কেউ বললো সাবারাং। মুশকিল হচ্ছে, উপজাতিদের যারা লেখাপড়া শিখেছে তারা বেশ ভালই বাংলা বলতে পারে। কিন্তু লেখাপড়া না জানা উপজাতিরা তত ভালো বাংলা বুঝে না, বলতেও পারেনা। মনে হলো কেনা বেচার জন্য যে কয়টি বাক্য বাংলা শেখা দরকার সে কয়টিই ওদের অনেকে শিখে নিয়েছে। যেমন, দাম কত, কম হবে, না না, কম নাই? বেশী প্রশ্ন করলে আর জবাব দিতে পারে না। আর উচ্চারণেও ওদের স্থানীয় টান থাকায় ওদের অনেক কথাই হঠাৎ করে বুঝতে একটু অসুবিধে হয়। প্রথমে ওদের কোন কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ওরা ধরেই নেয় যে আমি সেটা কেনার জন্য দরদাম করছি। আন্দাজ করে তাই ওরা দামটা বলে ফেলে আর সেটা গছিয়ে দেয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। আসলে আমি কি চাইছি সেটা বুঝাতে খানিকটা সময় লাগে।
কখনো কখনো সেটা ওদের বুঝতে পাশ থেকেও কেউ সাহায্য করে। কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, সাবারাং চাকমাদের এক প্রধান মসলা পাতা। মাছ-মাংস রান্নার সময় তার সাথে সাবারংয়ের কাঁচা পাতা মিশিয়ে রান্না করে। রান্নায় স্বাদ বেশী হয়। হাতের মুঠোর মতো এক আঁটি সাবারাং বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়।
এরপর পেলাম আর এক সুগন্ধি শাক রয়নাপাতা, ইয়েরিং শাক। নাপ্পি আর শুটকী রান্না হয় এসব দিয়ে। ভাগা করে এসব শাক বিক্রি হচ্ছ্ েপ্রতি ভাগা ১০ থেকে ১৫ টাকা। চিচিঙ্গার মতো চেহারার আর এক ধরনের ছোট আকারের সবজি বিক্রি হতে দেখলাম। দাম শুনেই চোখ চড়ক গাছ, প্রতি কেজি ৬০ টাকা। সে সবজির নাম কয়দা বা কইডা। আরও পেলাম তিদেগুলা, তারা, কচু, তিতবেগুন, ডুমুরশিম, কলার থোড়, কলার মোচা, কচি কাঁঠাল, গুটগুইট্টা, জুম মরিচ, জুম কুমড়া ইত্যাদি। এসব শাক সবজি সমতলে নেই, একান্তই পাহাড়ের ফসল। আশেপাশের গ্রাম থেকে উপজাতীয়রা এসব শাকসবজি তুলে এনেছে শহরের বাসিন্দা উপজাতিদের জন্য যাদের জুমে বা পাহাড়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই, অথচ নিজস্ব ঐতিহ্যের খাবার খেতে চায়।
সকালবেলা উপজাতিদের কাঁচা বাজার দর্শন শেষে চলে গিয়েছিলাম এক মারমা পল্লীতে। সেখান থেকে ফিরে এসে সন্ধ্যেয় ডাক বাংলো থেকে আবার বের হলাম সেই বনরূপা বাজারেই। তবে অন্য গলিতে। উদ্দেশ্য একটু হাঁটাহাঁটি আর রাতের খাওয়া।
হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে ঢুকলাম বাজারের ভেতরেই এক উপজাতীয় খাবারের হোটেলে। হোটেলের নাম ‘আইরিস হোটেল’। জানিনা আয়ারল্যান্ডের সাথে এ হোটেলের কারো কোন সম্পর্ক আছে কি না। একজন চাকমা মহিলা ক্যাশে বসে আছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিদি, ভাত হবে?’ চুরুট টানছিলেন। চুরুটটা নামিয়ে হাসিমুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। হোটেলটার ভেতরে একটা মেনু বোর্ড আছে- স্কুলের ক্লাসরুমের মতো একটা ব্ল্যাকবোর্ড। তার উপর হোটেলের নাম লেখা, নামের নীচে তারিখ ২২-৬-২০১০। তার নীচে চক দিয়ে কি কি খাবার সেদিন আছে তার নাম বা মেনু লেখা, পাশে দামও। মেনুটায় চোখ বুলিয়ে নিতেই চোখ চড়কগাছ। এইসব সাপ ব্যাঙ দিয়ে খেতে হবে! বিশটি আইটেমের নাম লেখা। খাবারের নামগুলো দেখলাম ভাত প্রতি প্লেট ৬টাকা, সবজি প্রতি সিঙ্গেল ১৫ টাকা, শূকরের মাংস প্রতি প্লেট ৪০ টাকা, শূকরের কলিজা ৪৫টাকা, বন্য শূকরের মাংস ৫০ টাকা, বন্য হরিণের মাংস ৬০টাকা, গরু/মহিষের মাংস ৭০টাকা, কুইচ্যা ৪৫টাকা, শুটকী মাছ ৪০টাকা, ব্যাঙ ৪৫টাকা, শাকমরিচ ১৫ টাকা, দেশী মুরগী ছোট পিস ৬০ টাকা, হাঙ্গর মাছ ৪০ টাকা, মাছ ৪০ টাকা, চিংড়ি ৪৫ টাকা, মুরগির কলিজা ৬০ টাকা, শামুক ৪০ টাকা, কচ্ছপ মাংস ৮০টাকা, বাচ্চুরী ২০টাকা। ‘দিদি, বাচ্চুরী কি? গরুর বাচ্চার মাংস?’
‘কি সেইটা খাই দেখতে পারেন।’
‘দাম আর একটু কমান যায় না?’ একটু রসিকতার জন্য বললাম।
‘ইহ্, খালি গিরগিরায়।’
সবাই দিদির কথা শুনে হেসে উঠলাম। তারিক ভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘দিদি, গিরগিরায় কি?’
‘আফনাগো কই নাই তো। মোবাইলে কতা করছিলাম, ব্যারাম হইছে তো। রোগী খালি কাঁপায়। আমরা তারে কই গিরগিরায়।’
দিদির কথাটা মূহুর্তের মধ্যে আমাদের মাঝে মার্কেট পেয়ে গেল, মুখে মুখে ফিরতে লাগলা, খালি গিরগিরায়। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলাম না, আসলে আমরা রাতের ভাত খাব কি দিয়ে?