নওগাঁ জেলা

Naogaon, 6500 ,Bangladesh
নওগাঁ জেলা নওগাঁ জেলা is one of the popular Region located in ,Naogaon listed under Landmark in Naogaon ,

Contact Details & Working Hours

More about নওগাঁ জেলা

নওগাঁ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ‘নও’ (নতুন -ফরাসী শব্দ ) ও‘ গাঁ’ (গ্রাম ) শব্দ দু’টি হতে । এই শব্দ দু’টির অর্থ হলো নতুন গ্রাম । অসংখ্য ছোট ছোট নদীর লীলাক্ষেত্র এ অঞ্চল । আত্রাই নদী তীরবর্তী এলাকায় নদী বন্দর এলাকা ঘিরে নতুন যে গ্রাম গড়ে উঠে , কালক্রমে তা-ই নওগাঁ শহর এবং সর্বশেষ নওগাঁ জেলায় রুপান্তরিত হয়। নওগাঁ শহর ছিল রাজশাহী জেলার অন্তর্গত । কালক্রমে এ এলাকাটি গ্রাম থেকে থানা এবং থানা থেকে মহকুমায় রুপ নেয় । ১৯৮৪ এর ১ মার্চ- এ নওগাঁ মহকুমা ১১টি উপজেলা নিয়ে জেলা হিসেবে ঘোষিত হয় । বাংলাদেশ উত্তর -পশ্চিমভাগ বাংলাদেশ - ভারত আর্ন্তজার্তিক সীমা রেখা সংলগ্ন যে ভূখন্ডটি ১৯৮৪ খ্রিঃ এর ১ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত অবিভক্ত রাজশাহী জেলার অধীন নওগাঁ মহকুমা হিসেবে গণ্য হতো, তা - ই এখন হয়েছে বাংলাদেশের কন্ঠশোভা নওগাঁ জেলা ।
এক নজরে:.... নিচে বিস্তারিত
০১। নওগাঁ জেলায় উন্নীত হয়ঃ ১ মার্চ, ১৯৮৪ খ্রিঃ
০২। আয়তনঃ ৩,৪৩৫.৬৭ বঃকিঃ (১,৩২৬.৫২ বঃমাঃ)
০৩। লোক সংখ্যাঃ ২৩,৮৫,৯০০ জন ( পুরুষ-১২,৩০,০০০ জন এবং মহিলা-১১,৫৫,৯০০জন) (২০০১ সনের আদম শুমারী অনুযায়ী)
০৪। উপজেলার সংখ্যাঃ ১১ টি
০৫। পৌর সভার সংখ্যাঃ ০৩ টি
০৬। ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যাঃ ৯৯টি
০৭। গ্রামের সংখ্যাঃ ২৮৫৪টি
০৮। ভূ-প্রকৃতিঃ দোঁয়াশ/বরেন্দ্র
০৯। ধর্মঃ ইসলাম, সনাতন, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি
১০। উপজাতিঃ সাওতাল, উরাও, মুন্ডা, সুরিয়া পাহাড়ি, মাহালি, বাঁশফোড়, কুরমি ইত্যাদি
১১। বিখ্যাত ব্যক্তিঃ তালিম হোসাইন, তৈয়ব উদ্দিন আহমেদ, চৌধুরী, মোজাফফর হোসাইন কাকি, বাবু, কুমুদ নাথ দাস, মোঃ আব্দুল জলিল, মোঃ আখতার হামিদ সিদ্দিকী
১২। কৃষিজাত খাদ্যঃ ইরি, বোরো, রোপা আমন, ইক্ষু, ভুট্রা, আলু, শরিষা,গম, আম, কলা ইত্যাদি
১৩। ক্ষুদ্র শিল্প কারখানাঃ ১২৮৬টি (অটোমেটিক রাইস মিল, হাসকিং মিল, আইস মিল, স-মিল ইত্যাদি)
১৪। নদীঃ ছোট যমুনা, আত্রাই, পুনর্ভবা
১৫। দর্শনীয় সহান সমূহঃ
১.কুসুম্বা মসজিদ (মান্দা)
২.পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার (বদলগাছী)
৩. পতিসর কাছারী বাড়ী (আত্রাই)
৪. ভীমের পান্টি (ধামইরহাট)
৫. দিব্যক জয়স্তম্ভ (পত্মীতলা)
৬. মাহিসন্তোষ(ধামইরহাট)
৭. বলিহার রাজবাড়ী (নওগাঁসদর)
৮. আলতাদিঘী (ধামইরহাট)
৯. জগদল বাড়ী (ধামইরহাট)
১০. হলুদ বিহার (বদলগাছী)
১১. দুবলহাটী জমিদারবাড়ী (নওগাঁ সদর)
১৬। ডাক বাংলোঃ ১৩ টি
১৭। বি, ও পিঃ ২৬ টি
১৮। সিনেমা হলঃ ২১ টি
১৯। টেলিফোন একচেঞ্জঃ ১২ টি
২০। মসজিদঃ ৪,৫৭০ টি
২১। মন্দিরঃ ৫৪২ টি
২২। গির্জাঃ ৫৩ টি
২৩। রাস্তাঃ
(ক) সড়ক ও জনপথ বিভাগেরঃ ৫১৬ কিঃমিঃ (পাকা-৪০১.২৫ কিঃমিঃ, এইচবিবি- ১৫কিঃমিঃ , কাঁচা- ৯৯.৭৫ কিঃমিঃ)
(খ) এলজিইডি এরঃ ৫০৪৮ কিঃমিঃ(পাকা-১১৯১ কিঃমিঃ, এইচবিবি-১৭৫কিঃমিঃ , কাঁচা- ৩৬৮২ কিঃমিঃ)
(গ) জেলা পরিষদেরঃ ১৬৯৩.৭৫ কিঃমিঃ (পাকা ,এইচবিবি ও কাঁচা সহ)
২৪। রেল পথঃ ২৭ কিঃমিঃ
২৫। রেলওয়ে স্টেশনঃ ৩ টি ( রাণীনগর , শাহাগোলা ও আহসানগঞ্জ )

শিক্ষা বিভাগ
০১। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ঃ ৭৯৪ টি
০২। রেজিঃ বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ঃ ৪৮২ টি
০৩। সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ঃ ৪ টি
০৪। বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ঃ ৩৭৫ টি
০৫। বেসরকারী নিমণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ঃ ৭৫ টি
০৬। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজঃ ১ টি
০৭। সরকারী মহাবিদ্যালয়ঃ ৬ টি
০৮। বেসরকারী মহাবিদ্যালয়ঃ ৭৪ টি
০৯। বেসরকারী কৃষি কলেজঃ ২টি
১০। কামিল মাদ্রাসাঃ ২ টি
১১। ফাজিল মাদ্রাসাঃ ৩৩ টি
১২। আলিম মাদ্রাসাঃ ৪০ টি
১৩। দাখিল মাদ্রাসাঃ ২০২ টি
১৪। সরকারী টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজঃ ১টি
১৫। এস,এস,সি (ভোকেশনাল) স্কুলঃ ৩৮ টি
১৬। এইচ,এস,সি ( বি,এম ) কলেজঃ ৪৪ টি
১৭। শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (পি,টি,আই)ঃ ১টি
১৮। পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটঃ ১টি
১৯। শিক্ষার হারঃ গড় - ৬২.৫২% ( পুরুষ- ৬৬.৪৩% এবং মহিলা- ৫৮.৬০%)

কৃষি বিভাগ
০১। মোট জমির পরিমাণঃ ৩,৫০,৬৫১ হেঃ
০২। আবাদী জমির পরিমাণঃ ২,৭৩,৮৩২ হেঃ
০৩। এক ফসলী জমির পরিমাণঃ ৪৪,৪৮৬ হেঃ
০৪। দো- ফসলী জমির পরিমাণঃ ১,৬৩,৮৯৩ হেঃ
০৫। তিন ফসলী জমির পরিমাণঃ ৬১,২০৫ হেঃ
০৬। আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণঃ ২,৮৩৩ হেঃ
০৭। সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণঃ ২,১২,৪৫৬ হেঃ
০৮। চাষী পরিবারের সংখ্যাঃ ৪,৬৪,১২৮ টি

মৎস্য ও পশু সম্পদ বিভাগ
০১। মৎস্য ও পোনা উৎপাদন খামারঃ
(ক) সরকারী-৩ টি (১টি নিজস্ব ও ২টি ইজারা প্রদত্ত)
(খ) বেসরকারী- ২৬টি
০২। মোট আবাদী পুকুরের সংখ্যাঃ ৪৩,৮৬০ টি
০৩। মৎস্য চাষের আওতাধীন পুকুরের সংখ্যাঃ ৪৩,৮৬০ টি
০৪। পশু চিকিৎসালয়ঃ ১১ টি
০৫। কৃত্রিম প্রজনন উপ-কেন্দ্রঃ ১১টি
০৬। কৃত্রিম প্রজনন পয়েন্টঃ ২৮ টি
০৭। পশু কল্যাণ কেন্দ্রঃ ২১ টি

রাজস্ব বিভাগ
০১। উপজেলা ভূমি অফিসঃ ১১ টি
০২। ইউনিয়ন ভূমি অফিসঃ ৪৮ টি
০৩। খাস জমির পরিমাণঃ
(ক) কৃষি- ৩২,৪৯৪.৩৭৪৭ একর
(খ) অকৃষি ১৫,৫৯৬.৯১৫৩ একর মোট = ৪৮,০৯১.২৯০০ একর
০৪। ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যাঃ ১,৩২,০৮০ টি
০৫। আদর্শ গ্রামের সংখ্যাঃ ১৭ টি
০৬। আবাসনের সংখ্যাঃ ১৮ টি
০৭। আশ্রায়নের সংখ্যাঃ ১০টি
০৮। খাস পুকুরের সংখ্যাঃ ৭,৭০৫ টি
০৯। হাট বাজারের সংখ্যাঃ ২১৩ টি
১০। জলমহালের সংখ্যাঃ ২২ টি
১১। বালু মহালের সংখ্যাঃ ১৪ টি
১২। খেয়াঘাটের সংখ্যাঃ ৭৫ টি

সেচ ব্যবস্থা
০১। গভীর নলকূপের সংখ্যাঃ ৩,৭১৬ টি
০২। অগভীর নলকূপের সংখ্যাঃ ৬৮,৮১৮ টি
০৩। শক্তি চালিত পাম্পের সংখ্যাঃ ৩,০২১ টি
০৪। অন্যান্যঃ ৮৫৫ টি

স্বাস্থ্য ও পরিবার- পরিকল্পনা বিভাগ
০১। আধুনিক সদর হাসপাতালঃ ১ টি
০২। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সঃ ১০টি
০৩। ইউনিয়ন সাব সেন্টারঃ ৪০ টি
০৪। পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র (এফডব্লিউসি): ৬১ টি
০৫। এম,সি, ডবিস্নউ, সিঃ ২টি

খাদ্য বিভাগ
০১। এল,এস, ডি - এর সংখ্যা : ১৯ টি (মোট ধারণ ক্ষমতা ৩৪,২৫০ মেঃ টন)

নওগাঁ প্রাচীন পৌন্ড্রবর্ধন ভূক্ত অঞ্চল ছিল। অন্য দিকে এটি আবার বরেন্দ্র ভূমিরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ । নওগাঁর অধিবাসীরা ছিল প্রাচীন পুন্ড্র জাতির বংশধর । নৃতাত্বিকদের মতে , পুন্ডরা বিশ্বামিত্র বংশধর এবং বৈদিক যুগের মানুষ । মহাভারত পুন্ড্রদের অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমার ঔরষজাত বলি রাজার বংশধর বলে উল্লেখ করা হয়েছে । আবার কারো মতে, বাংলার আদিম পাদদর বংশধর রুপে পুন্ড্রদের বলা হয়েছে । এদিক দিয়ে বিচার করলে নওগাঁ যে প্রাচীন জনগোষ্ঠির আবাসস্থল ছিল তা সহজেই বলা যায় ।
নওগাঁ জেলা আদিকাল হতেই বৈচিত্রে ভরপুর । ছোট ছোট নদী বহুল এ জেলা প্রাচীনকাল হতেই কৃষি কাজের জন্য প্রসদ্ধি । কৃষি কাজের জন্য অত্যন্ত উপযোগী এলাকায় বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে অসংখ্য জমিদার গোষ্ঠী গড়ে উঠে । এ জমিদার গোষ্ঠীর আশ্রয়েই কৃষি কাজ সহযোগী হিসেবে খ্যাত সাঁওতাল গোষ্ঠীর আগমন ঘটতে শুরু করে এ অঞ্চল । সাঁওতাল গোষ্ঠীর মতে এ জেলায় বসবাসরত অন্যান্য আদিবাসীদের মধ্যে মাল পাহাড়িয়া, কুর্মি,মহালী ও মুন্ডা বিশেষভাবে খ্যাত । নানা জাতি ও নানা ধর্মের মানুষের সমন্বয়ে গঠিত নওগাঁ জেলা মানব বৈচিত্র্যে ভরপুর । অসংখ্য পুরাতন মসজিদ , মন্দির,গীর্জা ও জমিদার বাড়ি প্রমাণ করে নওগাঁ জেলা সভ্যতার ইতিহাস অনেক পুরাতন ।

নওগাঁ জেলাঃ প্রশাসনিক বিবর্তন :
পটভূমি (ক) জেলা প্রশাসন : পলাশী পরবর্তী অষ্টাদশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির লাগামহীন শোষণ নিপীড়ণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত গণঅসন্তোষ বার বার সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়। দীর্ঘস্থায়ী ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০), ত্রিপুরায় সমশের গাজী, সন্দীপের আবু তোরাপ, রংপুরের নূরলদীনের মতো বিদ্রোহী নেতাদের আবির্ভাব, সংঘাত ও সংঘর্ষ কোম্পানি শাসনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল।
ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে (১৭৬৯-৭০) বাংলার এক কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, এক-তৃতীয়াংশ জমি অনাবাদের জন্য জনহীন অরণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল। মফস্বলে দস্যু তস্করের উপদ্রব ভয়ানক বৃদ্ধি পেয়েছিল। বহু জেলায় রাজস্ব আদায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
পরাধীন বাংলার সেই মর্মন্তুদ প্রেক্ষাপটে ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭২-১৭৮৩)-এর সময় থেকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে লর্ড কর্ণওয়ালিসের আমলে (১৭৮৬-’৯৬) এসে ইংল্যান্ডের জেলা ব্যবস্থার অনুকরণে এদেশে আধুনিক জেলা প্রশাসন প্রবর্তিত হয়। ১৭৯৩ এর কর্ণওয়ালিস কোড অনুসারে পূর্বতন জেলার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কালেক্টরের স্থলে প্রতি জেলায় একজন করে জেলা জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন। জজের অধীনে একজন রেজিস্ট্রার ও কয়েকজন মুন্সেফ বা ‘নেটিভ’ কমিশনার নিযুক্ত হন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব জমিদারদের বদলে কোম্পানির কর্মচারিদের উপর ন্যস্ত হয়। কয়েক ক্রোশ পরপর থানা স্থাপন করে একজন দারোগার উপর থানার ভার দেওয়া হয়। বৃহদায়তন জেলাগুলোর সীমানা রদবদল করে নতুন জেলা গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
পটভূমি (খ) মহকুমা প্রশাসন : কর্ণওয়ালিস প্রবর্তিত জেলা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নির্বিঘ্ন করা। সে জন্যই নতুন জেলা প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা দেখা দেয়। কিন্তু সেটা ছিল যথেষ্ট ব্যয় সাপেক্ষ। কোম্পানির লক্ষ্য ছিল কম খরচে বেশি মুনাফা অর্জন। তাই নতুন জেলা গঠনের প্রক্রিয়াকে মন্থর করে ১৮১০ সালের ১৬ রেগুলেশন অনুযায়ী একই জেলার দূরবর্তী অঞ্চলে প্রয়োজন বোধে আলাদা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের জন্য জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদ সৃষ্টি করা হয়। এরকম গোঁজামিল ব্যবস্থার পরিবর্তে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক (১৮২৮-’৩৫) বড় জেলাগুলোর দূরবর্তী অঞ্চলে সাবডিভিশনাল অফিসার নিয়োগ করেন। বড় গ্রাম, হাটবাজার বা জমিদারী কাচারির মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সাবডিভিশন বা মহকুমা কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। পরে মহকুমাগুলোতে অ্যাসিস্টেন্ট কালেক্টর ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়। ১৮২৫ খ্রিঃ রাজশাহী জেলা সদর নাটোর থেকে রামপুর বোয়ালিয়াতে স্থানাত্মরিত হয়। ১৯২৯ হতে নাটোর একটি স্বতন্ত্র মহকুমার মর্যাদা লাভ করে। ১৮৫৬ সালে এরকম মহকুমার সংখ্যা দাঁড়ায় তেত্রিশ। অন্যদিকে, বলতে গেলে, বেন্টিং এর আমল থেকেই, বাংলার নানা স্থানে পুনরায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে। ওয়াহাবী আন্দোলন, তিতুমীরের সংগ্রাম, গারো বিদ্রোহ, ফরাজী বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহে দেশের মাটিতে বহু রক্ত ঝরে। তার পরে পরেই সারা বাংলায় প্রবল নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-’৬১) দেখা দেয়। এমতাবস্থায় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দ্বিতীয় লেফটেন্যান্ট গভর্ণর সার জন পিটার গ্রান্ট (১৮৫৯-’৬২) প্রবর্তিত ব্যবস্থা জেলা ও থানার মধ্যবর্তী সমন্বিত এক প্রশাসনিক দপ্তর হিসেবে জেলাগুলোকে মহকুমায় বিভক্ত করা শুরু হয়।
(গ) নওগাঁ মহকুমাঃ গঠন ও বিস্তার : তৎকালীন রাজশাহী জেলার উত্তর প্রামেত্ম মান্দা, নওগাঁ ও পাঁচুপুর- এই তিনটি মাত্র থানা নিয়ে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে নওগাঁ মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮১ সালের পর বেঙ্গল সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী এর আয়তন ছিল ৬০৩ বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা ২,৬৮,৫৭৯ জন মাত্র। যতদূর জানা যায়, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দেও নওগাঁ বান্দাইখাড়া থানাধীন একটি ছোট নদী বন্দর ছিল মাত্র। সম্ভবত মহকুমা সদর নির্বাচিত হওয়ায় তার অব্যবহিত পূর্বে থানা বান্দাইখাড়া থেকে নওগাঁয় স্থানাত্মরিত হয়। এর আগে বান্দাইখাড়া এবং মান্দা থানা রাজশাহী সদর মহকুমার অধীনে ছিল। ১৮৭৫ পর্যন্ত পাঁচুপুর বলে পৃথক কোন থানার নাম পাওয়া যায়না। নওগাঁ মহকুমা গঠন কল্পে প্রধানতঃ নাটোর মহকুমাধীন বিশালাকার সিংড়া থানার অংশ বিশেষ এবং সন্নিহিত অন্যান্য এলাকা থেকে কিছু অংশ নিয়ে ১৬৫ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট পাঁচুপুর থানা গঠিত হয়। এর লোক সংখা দাঁড়ায় ৭৯,৪৩১ জন মাত্র। মান্দা অবশ্য একটি পুরাতন থানা। ১৮৮১-র প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুসারে তখন এর আয়তন ২৯৯ বর্গমাইল এবং লোক সংখ্যা ১,০৩,৩০৮ জন ছিল। ১৮৭২-র তুলনায় ১৮৮১-তে মান্দা থানার সীমানায় সাইত্রিশ এবং নওগাঁ থানার সীমানায় (বান্দাইখাড়ার তুলনায়) এক বর্গমাইল বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়।ঐ সময়ের জেলা সীমানা অনুসারে পাঁচুপুর-নওগাঁ-মান্দা এলাকাটি কেবল রাজশাহী জেলার নয়, মালদা জেলার পূর্ব, দিনাজপুর জেলার দক্ষিণ এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা সংলগ্ন একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল ছিল। প্রত্যেকটি জেলা সদর থেকে বহুদূরে অবস্থিত হওয়ায় অঞ্চলটিতে দস্যুতস্করের উপদ্রব ছিল। কিন্তু মনে হয়, এখানকার রাজনৈতিক তৎপরতাই ব্রিটিশ শাসকদের বেশি দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছিল। সেকালে বর্তমান রাণীনগর উপজেলার অন্তর্গত বাহাদুরপুর ও তৎসংলগ্ন কয়েকটি গ্রাম ছিল ওয়াহাবী তৎপরতার ঘাঁটি স্বরূপ। রাজশাহী শহরের সামান্য উত্তরে অবস্থিত সোমাপুরা গ্রামের ওয়াহাবী ঘাঁটির সঙ্গে এখানকার গোপন যোগাযোগ ছিল। তখন মান্দা ও আত্রাই এলাকায় প্রচুর নীলের চাষ হত। বর্তমান আত্রাই উপজেলার সাহেবগঞ্জ, রাণীনগরের চকউজীর, মান্দার জোকাহাট-ডাসপাড়া ও কালিকাপুর নীলকুঠি বিখ্যাত ছিল। ১৮৫৯-৬১ সালের নীল বিদ্রোহ এই অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৫৯-৬১ সালের নীল বিদ্রোহ এই অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সংগ্রামী নীল চাষীদের হাতে নাজেহাল ইংরেজ কুঠিয়ালরা তখনকার মতো নীল চাষ গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এসব অরাজকতা(!) রোধকল্পেই সম্ভবত এখানে একটি নতুন মহকুমা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু মহকুমা সদরের স্থান নির্বাচন নিয়ে প্রথমে বেশ বিভ্রাট বেধেছিল বলে মনে হয়। নওগাঁ মহকুমা গঠনের আগে থেকে থানা সদর বান্দাইখাড়াতে একটি মুন্সেফ চৌকি প্রতিষ্ঠিত ছিল। চকদেবের (মরহুম) শেখ ইমান উদ্দিন জানিয়েছেন মান্দা থানার নুরুলস্নাবাদেও একটি মুন্সেফ চৌকি ছিল। মুন্সেফগণ তখন ফৌজদারি মামলারও বিচার করতেন। ১৮৭৯ খ্রিঃ নর্দাণ বেঙ্গল রেলপথ চালু হবার আগে ভাগীরথী-পদ্মা নৌপথই ছিল রাজধানী কলকাতার সঙ্গে জেলা সদর রাজশাহীর যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন। ঐ পথে সহজে যাতে নতুন মহকুমা সদরে পৌঁছা যায় সেজন্য রাজশাহীর অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী স্থান মান্দা থানার এলেঙ্গা গ্রামে প্রথমে মহকুমা অফিস স্থাপন করা হয়। গ্রামটি এখন প্রসাদপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত। সেকালে মান্দা অঞ্চলে ডাকাতদের তৎপরতা বৃদ্ধি ও সেখানে মহকুমা সদর কার্যালয় স্থাপনের অন্যতম কারণ হতে পারে। বর্তমান মান্দা থানা ও ডাকবাংলার পার্শ্ববর্তী একটি স্থানকে লোকে ডাকিনীতলা বলে। সাধু ব্যবহারে একে দক্ষিণতলা বলা হয়। কথিত আছে যে, পূর্বে ডাকাতি করতে যাবার সময় ডাকাতরা সেখানে মহিমাময়ী দক্ষিণী মা দুর্গার উদ্দেশ্যে ছাগবলি দিত। ‘দক্ষিণী’ শব্দটি ‘দাক্ষায়নী’ (সতী)-র অপভ্রংশ হতে পারে। তখন থানা সদর মাইল ছয় পশ্চিমে ঠাকুরমান্দাতে ছিল। মহকুমা সদর বেশ কিছুকাল এলেঙ্গা গ্রামেই ছিল। এদিকে ১৮৭৪-৭৫ সালে নর্দাণ বেঙ্গল রেলপথের কাজ শুরু হয়ে যায়। রেলপথ স্থাপন সুনিশ্চিত জেনে মহকুমার প্রান্তসীমায় অবস্থিতি সত্ত্বেও যোগাযোগ সুবিধার দিকে লক্ষ্য রেখে রেলপথের নিকটবর্তী বন্দর নওগাঁয় তা স্থানান্তর করা হয়। নওগাঁ মহকুমা কার্যালয়ের পুরানো কাগজপত্রে যে রাবার সীলের ছাপ লক্ষ্য করা গেছে তা সবই ১৮৮২ খ্রিঃ এর। ফলে কেউ কেউ ভুল করে ঐ বছরকে মহকুমার প্রতিষ্ঠাকাল ভেবেছেন। এটা ঠিক নয়। তবে এমন হতে পারে যে, ঐ বছরই মহকুমা সদর এলেঙ্গা থেকে নওগাঁয় স্থানান্তরিত হয়েছিল কোন নিশ্চিত হতে নেই।
নওগাঁয় মহকুমা সদর স্থাপন বা স্থানান্তরের পেছনে যোগাযোগ সুবিধা ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্বার্থ নিহিত ছিল বলে জানা যায়। নওগাঁর প্রাক্তন মহকুমা প্রশাসক (১৯৩১-’৩৩) ও বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন, ‘নওগাঁ মহকুমা সৃষ্টির মূলে গাঁজার চাষ।’ তৎকালীন জেলা সীমানা অনুসারে যমুনা নদী বালুভরার নিকট থেকে শুরু করে নওগাঁ শহরের মধ্য দিয়ে প্রায় পনেরো মাইল দক্ষিণ অবধি বগুড়া ও রাজশাহী জেলার মাঝে সীমারেখা এঁকে প্রবাহিত হবার পরে পুরোপুরি রাজশাহী জেলায় প্রবেশ করতো। অর্থাৎ যমুনার পূর্বতীরবর্তী পার-নওগাঁ, সুলতানপুরসহ দক্ষিণে রঘুরামপুরের (এখন সাহাগোলা) সন্নিহিত পশ্চিম এলাকা পর্যন্ত বগুড়া জেলার অর্ন্তগত। বালুভরা এবং বদলগাছির সংলগ্ন কয়েকটি পশ্চিম তীরবর্তী গ্রাম বদলগাছি থানার মধ্যে থাকলেও ঐ থানা প্রধানত যমুনার পূর্বতীরে বিস্তৃত ছিল। বদলগাছি থানা তখন বগুড়া জেলার অধীনে ছিল। পূর্বে বগুড়া জেলার বদলগাছি এবং পশ্চিমে দিনাজপুর জেলার মহাদেবপুর থানার মধ্যবর্তী একটি সঙ্কীর্ণ গলি হয়ে নওগাঁ থানার সীমানা সম্ভবত চাকরাইলেরও উত্তর অবধি প্রসারিত ছিল। ১৯১৩-১৪ খ্রিঃ -এর জরিপ মানচিত্র অনুসারে বর্তমানে বদলগাছি থানার অর্ন্তগত চাকরাইল নওগাঁ থানার অধীনে ছিল। নওগাঁ মহকুমা সদর হবার পরেও বেশ কিছুকাল মুন্সেফকোর্ট বান্দাইখাড়াতে ছিল বলে জানা যায়। সম্ভবত সে কারণেও থানা নওগাঁয় স্থানান্তরিত হলেও সেখানে একটি পুলিশ আউটপোস্ট থেকে যায়। পরে পার্শ্ববর্তী নন্দনালী গ্রামে স্বতন্ত্র থানা হয়। ১৯৪৭ এর দু’এক বছর পূর্বে এটিও আউটপোস্টে পরিণত হয় এবং ১৯৭১ এর স্বাধীনতার পরে সম্পূর্ণ উঠে যায়। ১৮৯৬-৯৭ খ্রিঃ নওগাঁ মহকুমার সীমানা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ঐ সময় দিনাজপুর জেলা থেকে মহাদেবপুর থানাকে এবং বগুড়া জেলা থেকে বদলগাছি থানাকে রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমার সাথে যুক্ত করা হয়। বগুড়া জেলার আদমদিঘি এবং নবাবগঞ্জ থানার অনেক এলাকাও নওগাঁ মহকুমার অর্ন্তভুক্ত হয়। পার-নওগাঁ, সুলতানপুরসহ যমুনার পূর্বতীরের বিস্তৃত এলাকায় নওগাঁর সীমানা প্রসারিত হয়। বদলগাছি থানা ১৮২১ খ্রিঃ বগুড়া জেলা গঠনের পূর্বে দিনাজপুর জেলার অর্ন্তভুক্ত ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগেই নওগাঁ মহকুমার থানাগুলোর সীমানা পুনর্বিন্যস্ত হয় এবং নতুন কয়েকটি থানা গঠিত হয়। ১৯১১-১২ খ্রিঃ সম্ভবত পাঁচুপুর ও নওগাঁর অংশবিশেষ নিয়ে রাণীনগর একটি নতুন থানা হয়। তারপরে মান্দা থানা সদর ঠাকুরমান্দা থেকে সরিয়ে এনে আত্রাই নদীর পশ্চিম তীরে দোসতি গ্রামের বর্তমান জায়গায় স্থাপন করা হয়। মান্দার পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে নিয়ামতপুর থানা গঠিত হয়। একইভাবে তৎকালীন দিনাজপুর জেলার পত্নীতলা থানার উত্তর পূর্বাঞ্চল নিয়ে নতুন ধামুইরহাট থানা স্থাপিত হয়। নওগাঁ মহকুমা গঠনের আগে থেকেই আত্রাই একটি নদী বন্দর ছিল। ১৯২৯ এর মধ্যে পাট ব্যবসায়ে আত্রাই বেশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সেখানকার পাট ব্যবসায়ী আহসান মোল্লা প্রভূত অর্থ ও প্রতিপত্তির অধিকারী হন। তাঁরই প্রভাবে পাঁচুপুর থানা সদর আত্রাই ঘাটে স্থানান্তরিত হয়, নামও বদলে যায়। অন্যদিকে পাঁচুপুর থানার পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের দীর্ঘ দিনের দাবী অনুসারে এর কিছু এলাকা বগুড়া জেলার সঙ্গে যুক্ত করে সম্ভবত ১৯৩৫ সালে নন্দীগ্রাম পৃথক থানা হয়।১৯৪৯ খ্রিঃ পুনরায় নওগাঁ মহকুমার উল্লেখযোগ্য বিস্তৃতি ঘটে। ১৯৪৭ এর র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে দিনাজপুর জেলার পোরশা, পত্নীতলা ও ধামুরহাট থানা বগুড়া জেলার অর্ন্তভুক্ত হয়। ১৯৪৯ সালে পোরশা রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমার এবং পত্নীতলা ও ধামুরহাট নওগাঁ মহকুমার সঙ্গে যুক্ত হয়। নওগাঁ মহকুমার সর্বশেষ সীমানা বিস্তারের ঘটনাটি সাম্প্রতিক। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবী অনুসারে ১৯৮০ সালে পোরশা থানাকে নওগাঁ মহকুমার অর্ন্তভুক্ত করা হয়। এবং একই বছর ২রা জুলাই এর উত্তর ভাগের ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে নতুন সাপাহার থানা গঠিত হয়।
(ঘ) নওগাঁ জেলার জন্ম বেদনা : উত্তরবঙ্গের একটি সমৃদ্ধ মহকুমা হিসেবে নওগাঁকে জেলা করার দাবীটি বেশ পুরোনো। বৃটিশ আমলের শেষ ভাগ হতেই এ রকম একটি আকাংক্ষা লালন করা হচ্ছিল।বস্তুত বিভিন্ন সময়ে নওগাঁ মহকুমার সঙ্গে বিস্তৃত এলাকা যুক্ত হওয়াতে একে জেলায় উন্নীত করার দাবীটি যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছিল। আয়তনের ব্যাপক প্রসারতার জন্য ১৯৫৯ সালেই নওগাঁ পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর এই তিনটি সার্কেলে বিভক্ত ছিল। কিন্তু বিদেশী শাসনামলে নওগাঁ জেলা গঠনের ন্যায়সঙ্গত দাবীটি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছিল। ১৯৭১-র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দ্বারা পাকিস্তানি বর্বরতার কবলমুক্ত হবার পরে বাংলাদেশের সমস্ত মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার দাবী উত্থাপিত হয়। দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলও মহকুমাগুলোকে (সাংগঠনিক) জেলা হিসেবে উল্লেখ করতে থাকে। অবশেষে সরকারিভাবে ১৯৭৫ সালে মহকুমাগুলো জেলায় উন্নীত হয়। প্রতি জেলায় একজন ‘জেলা গভর্ণর ’ নিযুক্ত হন। কিন্তু এই ব্যবস্থা কার্যকর হবার পূর্বেই ঐ বছর পনের আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহীদ হন। পরিণামে সবকিছুই ভন্ডুল হয়ে যায়। পরবর্তীকালে পুনরায় নওগাঁকে জেলায় উন্নীত করার দাবী উত্থাপিত হতে থাকে। নওগাঁর বিভিন্ন স্তরের লোক নিয়ে জেলা বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়। এই পর্যায়ে সরকার নওগাঁ জেলা গঠনের দাবীটি নীতিগতভাবে মেনে নেন। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৮০-৮১ সালের মধ্যে জেলা প্রশাসনের সভাকক্ষসহ টিনের ছাউনিযুক্ত অফিসসমূহের নির্মাণ কাজও সম্পূর্ণ হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা মাত্র বাকি। এমন সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হন। নওগাঁকে জেলা করার কার্যক্রমটি আবারও পিছিয়ে যায়।
১৯৮২-তে সামরিক ক্ষমতা হাতে নেবার পরে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নীতি ঘোষণা করেন। তাতে প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে সাবেক থানা সার্কেলগুলো সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করে। সেগুলো প্রথমে মান উন্নীত থানায় ও পরে উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। অতঃপর সরকার মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ১৯৮৩-র শেষভাগ হতে ৮৪-র প্রথম ভাগের মধ্যে যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে সাবেক মহকুমাগুলো জেলায় রূপান্তরিত হয়। তারই এক পর্যায়ে ১৯৮৪-র পহেলা মার্চ বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক মন্ত্রী ড. শাফিয়া খাতুন আনুষ্ঠানিকভাবে নওগাঁ জেলা উদ্বোধন করেন।




শহর নওগাঁর রূপ-রূপান্তর:
(ক) অবস্থান : নওগাঁ জেলার সদর কার্যালয় ও প্রধান শহর নওগাঁ। ক্ষীণকায়া উপনদী ‘যমুনা’-র পশ্চিম তীরে মোটামোটিভাবে ২৪ডিগ্রী-৪৯ইঞ্চি উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৮ ডিগ্রী- ৫৭ ইঞ্চি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত এই শহর বাংলাদেশের নব পর্যায়ের জেলা শহরগুলোর তুলনায় বেশ সমৃদ্ধ, পরিচ্ছন্ন ও মনোরম। জেলার এক প্রান্তে দীর্ঘ পূর্ব সীমানার প্রায় মধ্য ভাগে নওগাঁ এর অবস্থান। শহরের কেন্দ্রস্থল হতে মাত্র চার মাইল পূর্বে বগুড়া জেলার সান্তাহার রেলওয়ে জংশন।
(খ) নামকরণ : নওগাঁ নামের গ্রাম হতেই নওগাঁ শহর; নওগাঁ শহরের নাম অনুসারে সাবেক নওগাঁ থানা ও মহকুমা এবং বর্তমান উপজেলা ও জেলার নামকরণ। কিন্তু এই জনপদের নাম নওগাঁ কেন হয়েছিল সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। প্রচলিত মত এই যে, সন্নিহিত নয়টি চক বা জনবসতি সমন্বয়ে গঠিত নয় গাঁ কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে নওগাঁ নাম ধারণ করেছে। এটি অসম্ভব কোন ব্যাপার নয়। অশিক্ষিত নওগাঁবাসী এক থেকে আট পর্যন্ত ঠিকমত উচ্চারণ করার পর নয়কে বলেন ‘নও’ বা ‘লও’। নওগাঁ পৌর এলাকা বর্তমানে যথেষ্ট সম্প্রসারিত হলেও শহরের কেন্দ্র এবং তৎসন্নিহিত খাস-নওগাঁ, হাট-নওগাঁ, পার-নওগাঁ, আরজী-নওগাঁ, চক ইলাম, চকদেব, চক এনায়েত, চকমুক্তার ও গঞ্জ নওগাঁই সাধারণভাবে নওগাঁ শহর হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। ১৯২০ সালের ক্যাডাস্ট্রিয়াল সার্ভে রেকর্ডে নওগাঁগঞ্জ নামে একটি পৃথক মৌজা ছিল। এখন বিলুপ্ত। চল্লিশ বছর পূর্বেও বাঙ্গাবাড়ি নওগাঁ শহরের মধ্যে গণ্য হতনা। তখন তা দূর্গাপুর ইউনিয়নের অর্ন্তগত ছিল। অবশ্য একটি জনপদের প্রারম্ভিক পতনকালে নতুন অর্থে সংস্কৃত ‘নব’ থেকে জাত হিন্দি ‘নয়া’ কিংবা ফরাসি ‘নও’ (যেমন- নওরোজ, নওশা) শব্দের সঙ্গে গ্রাম > গাঁও>=গাঁ শব্দ যুক্ত হয়েও নওগাঁ নামের উৎপত্তি হওয়া সম্ভব। নওগাঁ নামের বানান এবং উচ্চারণে বেশ বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। ১২৯৫ বঙ্গাব্দে শ্রী মুন্সী শুকরুলস্না তরফদার কর্তৃক প্রণীত একটি বাংলা অর্থ পুস্তকে নওগাঁকে নওগাঁও বলা হয়েছে। অন্যত্র এ রকম ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। শহর সন্নিহিত গ্রামবাসীদের অনেকে একে ‘লগাঁও’ বলেন।
(গ) প্রাচীন ইতিহাস : নওগাঁ শহরের এক মাইল পশ্চিমে চকবাড়া গ্রামের একটি পুকুরে ১৯৭০ খ্রিঃ একটি পাথরের মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। ঐ গ্রামের আর একটি পুকুরে বাঁধানো ঘাট রয়েছে। এর প্রাচীন ইতিহাস অজ্ঞাত। সন্দেহ নেই এটি একটি প্রাচীন জনপদ। গ্রামটির পাশ দিয়ে নদী প্রবাহিত হত বলে মনে হয়। হয়ত এখানকার নওগাঁ শহরের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। তবে এ থেকে এ এলাকায় জনবসতির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।১৯৩২ খ্রিঃ প্রকাশিত একটি ক্ষুদ্র পুসিত্মকাসূত্রে জানা যায় যে, নওগাঁ শহরের প্রাচীন অধিবাসী তরফদারগণ নাকি এখন থেকে চার শতাধিক বৎসর পূর্বে সুদূর আজমীর (মতান্তরে বাগদাদ) থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেন এবং পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদের নবাব সরকার হতে ‘তরফদার’ খেতাব পান। নবাবী আমলের বহু পূর্বেই একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ হিসেবে গড়ে না উঠলে তাদের পূর্ব পুরুষ নওগাঁয় এসে বসতি স্থাপন করবেন কেন? ১৭৬৪ খ্রিঃ. জেমস রেনেল বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকৃত এলাকাসমূহের জরিপ কাজ আরম্ভ করেন। ‘মেজর রেনেল অতি নিপুণ হস্তে তার কাজ সমাধা করে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের প্রথম ভূচিত্রাবলী প্রকাশ করেন।’ (বাঙলাদেশ-৫৩)
রেনেলের মানচিত্রে একটি নদী বন্দর হিসেবে নওগাঁর সুষ্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। রাজস্ব বিভাগের পুরাতন দলিলপত্রানুসারে ১৭৮২ খ্রিঃ নওগাঁয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি ফ্যাক্টরি ছিল। ফ্যাক্টরিটি কুমারখালি কুঠির তত্ত্ববাধানে পরিচালিত হত। সেটি যে কি ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। উত্তরণের পথে- পূর্বাপর ১৮৩৪ সালে নওগাঁ ছিল দুবলহাটী থানার অধীন। ১৮৭২ এর পূর্বেই কোন এক সময় থানা সদর বান্দাইখাড়াতে স্থানান্তরিত হয়। নওগাঁর সংলগ্ন, যমুনা নদীর পূর্ব তীরবর্তী সুলতানপুর তখন বগুড়া জেলার অধীন। সুলতানপুর দুপচাঁচিয়ার আনন্দনাথ চৌধুরীর এবং দুবলহাটির জমিদারীর অর্ন্তগত ছিল। চাউলের ব্যবসায় এবং ইংরেজ বণিকদের রেশম কেনাবেচার জন্যে সুলতানপুর বাজারের যথেষ্ট প্রসিদ্ধি ছিল। কিন্তু ঐ বাজারে খাজনা ভাগাভাগি নিয়ে দুই জমিদারের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। কুপিত দুবলহাটির রাজা নিজ এলাকা নওগাঁয় পাল্টা বাজার বসান এবং তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাবে নওগাঁর বাজার দ্রুত জমে ওঠে। সুলতানপুর তৃতীয় শ্রেণীর একটি গ্রাম্য বাজারে পরিণত হয়। অচিরে নওগাঁ বাজার রাজশাহী জেলার উত্তরাঞ্চলের তো বটেই বগুড়া জেলার পশ্চিমাঞ্চলের পক্ষেও নদীপথে পণ্য আমদানীর একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বদলগাছি ও আদমদীঘির উৎপাদিত চালের প্রধানতম বাজার তখন নওগাঁ।
এই সময় থেকেই নওগাঁ শহরে অর্থনৈতিক তৎপরতা প্রবল হয়ে ওঠতে থাকে। মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই সুদূর রাজস্থানের বিকানির থেকে কয়েকজন ভাগ্যান্বেষী মাড়োয়ারী নওগাঁ শহরে এসে ব্যবসায় শুরু করেন এবং শূন্য হাতে এসে কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা কয়েক বছরের মধ্যে প্রচুর টাকা পয়সার মালিক হন। নওগাঁর কাজী পরিবারের অবস্থা তখন তুঙ্গে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বস্ত্তত নওগাঁর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন মাড়োয়ারীগণ এবং কাজী পরিবার। প্রবাদ ছিল যে নওগাঁ শহরের বারো আনা মাড়োয়ারীদের আর কাজীদের, বাকি চার আনা অন্যদের। সুলতানপুরের পাল্টা বাজারটি প্রথমে নওগাঁর ডালপট্টি এলাকায় বসতো। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক পর্যন্ত তা সেখানেই ছিল বলে জানা যায়। দুবলহাটীর জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই নতুন বাজারের বিকাশে তৎকালে উদীয়মান প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তিনকড়ি সাহা, বলাই সাহা, মহেশ সাহা এবং পার-নওগাঁর মাতম বানিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। নওগাঁতে মহকুমা সদর প্রতিষ্ঠিত হবার সময়কালে এখানে সরকারি কোন পাকা ভবন ছিলনা। প্রথম দিকে, এমনকি থানা এবং হাজত খানা পর্যন্ত ছিল বেড়া ও টিনের চালা ঘরে। নওগাঁ শহরের প্রথম পাকা ভবন নির্মাণ করেন চগনলাল আগরওয়াল। তারপর বজরঙ্গ লাল আগরওয়াল এর পিতা লাদুরাম মাড়োয়ারী পাকা ভবন নির্মাণ করেন। তার সমকালে অথবা কিছু পরে নওগাঁ বাজারকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ‘ভবানী ভান্ডার’ নির্মিত হয়। দুবলহাটীর জমিদার ঘনদানাথ চৌধুরী এটি নির্মাণ করান বলে অনেকের অভিমত। জমিদারের নিজস্ব উদ্যোগে ভবানী ভান্ডারে বিরাট দোকান খোলা হয়। সেখানে মসলা-পাতি, কাপড়-চোপড়, বই-খাতা, এক কথায় মাটির পাতিল ও কলাপাতা বাদে সবই নাকি পাওয়া যেত। ভবানী ভান্ডারের আগে বা সমকালে কাজীদের পাকা ভবন নির্মিত হয়। ইতিমধ্যে ১৮৮৪ খ্রিঃ নওগাঁর তৎকালীন সাব-ডেপুটি কালেক্টর ও গাঁজা মহালের সুপারভাইজার বাবু কৃষ্ণধন বাগচির উদ্যোগে শহরে একটি এন্ট্রেন্স স্কুল এবং ১৮৯৬ খ্রিঃ দুবলহাটির জমিদারের উদ্যোগে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় নওগাঁবাসীর শিক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রগতি সাধিত হয়।বলা বাহুল্য, তখন পর্যন্তও নওগাঁ একটি শহর হিসেবে ততটা গড়ে উঠতে পারেনি। এর সারা অঙ্গে ছিল গ্রামীণ জীবনধারার সুষ্পষ্ট ছাপ। এখানকার বি এম সি কলেজ ভবনের আশেপাশের গভীর জঙ্গলে এক জাতের বাঘ এবং হাট নওগাঁর মরহুম আস্তান মাস্টার সাহেবের বাড়ির সন্নিহিত এলাকায় ছিল বড় বড় দাঁতাল শূকরের আবাস। শহর তখন বলতে গেলে কে ডি-র মোড় থেকে নদীর তীর ঘেঁষে কাচারি রোড, পুরাতন হাসপাতাল রোড, কাজী পাড়া, তরফদার পাড়া, হোটেলপট্টী, তুলাপট্টী, ভবানী ভান্ডার, চুড়িপট্টী এবং ডালপট্টী, ডাব পট্টী হয়ে পতিতালয় পর্যন্ত দুপাশের সঙ্কীর্ণ পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯১১ খ্রিঃ এর ১২ ডিসেম্বর দিল্লীতে সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষ্যে যে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় হয়েছিল, তার উদ্বৃত্ত অর্থে ১৯১৬ সালে নওগাঁ করোনেশন হল সোসাইটির জন্ম। তবে সোসাইটির বর্তমান থিয়েটার হলটির নির্মাণ কাজ সম্ভবত ১৯২০-২১ সালে সম্পন্ন হয়। তখনও শহরের মর্গ বা লাশকাটা ঘরটি ছিল থিয়েটার হলের সামান্য উত্তরে, বর্তমান সমবায় ব্যাংক ভবনের নিকটে। তার মাত্র কয়েক রশি ফাঁকে ছিল ভাগাড় ও মল ফেলার স্থান। আর শ্মশান ছিল এখানকার কালিতলা ক্লাব ভবনের পেছনে ‘ভুপেন বসাক নির্মিত মন্দিরের নিকটে। ১৯২৫ খ্রিঃ এর কাছাকাছি সময়েও চকদেব পাড়ায় এম এ রকীব সাহেবের বাসভবনের পশ্চাৎভাগে, এখানকার গোরস্থানসহ বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কেবল উলুখড়ের মাঠ ছিল।
(ঙ) নবীনা নওগাঁ : আধুনিক শহর হিসেবে নওগাঁর শুভযাত্রা, বলতে গেলে ১৯১৭-তে নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠার পর থেকে। ১৯২১ সালে ক্যামেল পার্ক নির্মাণের দ্বারা নওগাঁর সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। তারপরে ১৯২৩-এ যমুনা নদীর উপর লিটন সেতু নির্মিত হলে আধুনিক যুগ ও বাইরের জগতের সঙ্গে নওগাঁর মন দেওয়া নেয়া ত্বরান্বিত হয়। ১৯৩০ সালের মধ্যে গাঁজা সোসাইটির বেশকিছু বড় বড় ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়। এ সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন, ‘নওগাঁর যে পাড়াটি গাঁজা কালটিভেটার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি গড়ে তুলেছে সেটি একটি ছোটখাটো টাউনশিপ। সেখানে শহরের মতো

Map of নওগাঁ জেলা