মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য গণহত্যা ও নির্যাতন। এই গণহত্যার অন্তর্গত সব ধরণের হত্যা, শরণার্থী হিসেবে পালানোর সময় ও শরনার্থী শিবিরে মৃত্যু, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু সব কিছু। আর নির্যাতনের অন্তর্গত শুধু নারী নির্যাতন নয়, আতঙ্কের সৃষ্টি, নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন, হিন্দু না মুসলিম জানতে চাওয়া, ধরে নিয়ে বন্দি করে জিজ্ঞাসা করা, বাস্তু ত্যাগে বাধ্য করা, মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা।
আমরা আমাদের বিজয়কে বেশী গুরুত্ব দিয়েছি, গণহত্যা ও নির্যাতনকে নয়। বিজয়ী হওয়ার পর মানুষ সাধারণত বিজয়কে ভুলে যায়, কিন্তু গণহত্যা-নির্যাতনের মতো শোক আর অপমানকে সারাজীবন মনে রাখে। বাংলাদেশে ইতিহাস বিকৃতির কারণে আজ গণহত্যা ও নির্যাতন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর কারণ গুরুত্ব না দেয়ার মানসিকতা। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে
অসাম্প্রদায়িক ও গণমুখী ইতিহাস চর্চার সংগঠন ’বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী’ এর সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের প্রস্তাবে সম্মিলনীর উদ্যোগে দক্ষিণের জেলাশহর খুলনায় গড়ে উঠেছে ’১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। এর উদ্দেশ্য: মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা-নির্যাতন, বধ্যভূমি, গণকবর সংক্রান্ত তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা, এর বিশদ বিবরণ তৈরি, গণকবর/বধ্যভূমি চিহ্নিত করা, প্রদর্শনী, প্রকাশনা প্রভৃতি। এককথায় বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এ বিষয়টিই তুলে ধরা যে, ’স্বাধীনতা’ শব্দটি শুধু চারটি বর্ণের সমাহার নয়, এর পেছনে আছে লাখো মানুষের দুঃখবেদনা, অশ্রু, রক্ত, ক্ষোভ, নির্যাতন আর অপমান। এই ইতিহাস জেনে তারা যেন সত্য অনুধাবন ও রক্ষা করতে পারে এবং একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়তে পারে সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
২০১৪ সালের ১৭ মে খুলনা শহরে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। খুলনায় স্থাপিত হলেও এটি কোন আঞ্চলিক জাদুঘর নয়। একটি একটি জাতীয় জাদুঘর। বাংলাদেশের একমাত্র গণহত্যা জাদুঘরটি খুলনায় স্থাপন করার কারণ হচ্ছে খুলনার চুকনগরেই সবচেয়ে বড় ও নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিলো পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা।
মাননীয় প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা এই জাদুঘরকে সহায়তা দানের জন্য একখন্ড জমি এবং একটি বাড়ী দিয়েছেন। এটিকে সংস্কার করে জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়েছে। ট্রাস্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। নিয়মিত বিভিন্ন পেশার মানুষজনের পাশপাশি শিক্ষার্থীরা এখানে নিয়মিত আসছেন।
মাত্র তিন বছরে পা দেয়ার আগেই আমাদের আর্কাইভে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে নির্মমতার উপর প্রচুর আলোকচিত্র। আছে গণহত্যা বিষয়ক তথ্য, যা ক্রমাগত সংগৃহীত হয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে খুলনা বিভাগে ২০টি বধ্যভূমি ও নির্যাতনকেন্দ্রে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। আর্কাইভে আছে বধ্যভূমি সংক্রান্ত তথ্যভান্ডার, আলোকচিত্র, ও বিভিন্ন গ্রন্থ। আমাদের একটি বিশেষ প্রকল্প হচ্ছে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গণহত্যাস্থল কেন্দ্রিক প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যভিত্তিক গ্রন্থের ভিত্তিতে গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘন্ট গ্রন্থমালা প্রকাশ। ইতিমধ্যে ৩১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। জাদুঘর ট্রাস্টের উদ্যোগে প্রতিবছর একক বক্তৃতা, শহীদ স্মৃতি বক্তৃতা, এবং নানা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। পালন করা হচ্ছে বিশেষ দিবসগুলি। আমাদের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম ও অর্জনের মধ্যে রয়েছে:
জাতীয় জাদুঘরের সাথে যৌথ প্রদর্শনী।
ত্রিপুরা সরকারের সাথে ’গণহত্যা-নির্যাতন ১৯৭১’ শীর্ষক প্রদর্শনী।
আমাদের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ত্রিপুরা সরকার একটি জাতীয় উদ্যান তৈরি করেছে এবং সেখানে গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে একটি ভাস্কর্য উদ্যান গড়ে তোলা হয়েছে।
আমাদের উদ্যোগে ’মুক্তিযুদ্ধ ও ত্রিপুরা ১৯৭১’ শিরোণামে ত্রিপুরা জাদুঘরের একটি কক্ষ সজ্জিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ডাকবিভাগ গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘরের উপর একটি স্মারক খাম প্রকাশ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের বই বিক্রির জন্য জাদুঘরে একটি বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং দর্শনার্থীদের জন্য একটি ক্যাফেটেরিয়া রয়েছে। জাদুঘরের নিজস্ব গ্রন্থাগারে মুক্তিযুদ্ধের অঞ্চলভিত্তিক নানা প্রকাশনা ছাড়াও এ বিষয়ক আরো অনেক সমৃদ্ধ প্রকাশনা রয়েছে। জাদুঘরের অভ্যন্তরে একটি মুক্তমঞ্চ গড়া হয়েছে, নির্দিষ্ট সৌজন্যমূল্যের বিনিময়ে যেটি সংস্কৃতিসেবীরা ব্যবহার করতে পারবেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় গণহত্যা জাদুঘর চালু করেছে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্র (Centre for Genocide-Torture and Liberation War Studies) প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা এবং নির্যাতন নিয়ে তিন মাসের একটি একটি ইনটেনসিভ সার্টিফিকেট কোর্স করানো হবে। এই প্রকল্পের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
আমরা এই জাদুঘরের উদ্যোগ নিয়েছি বটে, কিন্তু এটি বিকশিত হতে সময় লাগবে। আর এ দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবার। তাই আপনাদের কাছে আহ্বান, সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের সহায়তা করুন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত শহীদদের নিদর্শন, স্মারক, আলোকচিত্র, বইপত্র, দলিল আমাদের দান করুন, বধ্যভূমি, গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য থাকলে জানান। যেহেতু, ’১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ একটি বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, এটি পরিচালনের জন্য অর্থেরও প্রয়োজন রয়েছে। আপনারা এই জাদুঘরকে শর্তহীন অর্থসাহায্য করুন। সবার সহযোগিতা পেলে সামনের বছরগুলিতে আমাদের কার্যক্রম আরো বিস্তৃত হবে এবং একে প্রাতিষ্ঠানিক পূর্ণরূপ দেয়া সম্ভব হবে।