একদিকে বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি, অপরদিকে দেশের প্রধান খরস্রোতা কর্ণফুলী, মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ছোট বড় পাহাড়। নদী-মেঘলা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের সু-প্রাচীন জনপদ চট্টগ্রাম। আমাদের প্রিয় আবাসভূমি। আরব-অনারব, ফরাসী, পর্তুগীজ, ইংরেজ, ব্রিটিশ, চায়নিজ সব দেশের সব জাতির মানুষকেই হাত ছানি দিয়ে ডেকেছে ইতিহাসের অনত্যম স্বাক্ষী আমাদের এই জনপদ। কে আসে নি এই জনপদে? আফ্রিকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটক থেকে ভাগ্যন্বেষী মোগল, তুর্কী, আর্য-অনার্য, সেন, পাল সবাই এসেছে এই জনপদে। আর এই জনপদের প্রাণ কেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর। ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এই বন্দরের বিপরীত দিকে অবস্থিত চট্টগ্রামের প্রাচীন জনপদ পটিয়া। কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত এই জনপদের অবস্থান চট্টগ্রামে শহরের সাথেই। যুগে যুগে পটিয়ার এই জনপদে জম্ম নিয়েছেন বহুজ্ঞানী, গুণী, সমাজসেবী, শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষাবিদ। তাদেরই অন্যতম মাওলানা আবদুস সোবহান। তাঁর নিরলস পরিশ্রম, কঠোর সাধনা, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, নিজ জাতি ও ধর্মের প্রতি সীমাহীন অনুরাগ, অবিচল লক্ষ্য ও ত্যাগে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে গড়ে উঠেছে এই বিদ্যালয়। শত বছরের এই ক্ষণে এসে প্রযুক্তি ও তথ্যের বিশ্ব মহাসড়কে (Information of Super Higway) যুক্ত হওয়ার এই মহাক্ষণে আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’য়ালার কাছে আমাদের বিদ্যালয়ের এই মহান প্রতিষ্ঠাতা’র বিদেহী আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করছি।
পটিয়া সদরের শূন্য কিলোমিটারে ১৯১৪ সালে আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে এটি একটি ধর্মীয় মক্তব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও সময়ের প্রয়োজনে এটিকে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় হিসেবে উন্নীত করা হয়। মাওলানা আবদুস সোবহান নামের এক মহান শিক্ষানুরাগী ও সমাজ সেবক বৃটিশ শাসনামলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করলেও বর্তমানে সকল ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের লোকের সন্তানরা বিদ্যালয়টিতে অধ্যয়ন করছে।
মাওলানা আবদুস সোবহান বিংশ শতাব্দীতে পটিয়া পৌর সদরের গোবিন্দারখীল গ্রামের এক অভিজাত অথচ দরিদ্র পরিবারে জম্ম গ্রহন করেন। ১৯১৮ সালের মে মাসের কোন এক তারিখে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তিনি উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করতে না পারলেও পারিবারিক বলয়ে তিনি কোরআন-হাদিস সহ ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। বৃটিশ উপনিবেশ যুগে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক কোন ডিগ্রী না থাকলেও তিনি ছিলেন ইসলামী ও শরীয়াহ জ্ঞানের অধিকারী। এটা অত্যন্ত বিস্ময়কর এবং ঐতিহাসিকদের নিকট গবেষণার বিষয় যে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অজপাড়া গাঁয়ে আর্থিক অস্বচ্ছলতার মধ্যেও তিনি কেন নিজের সব স্বাদ-আহলাদ বিসর্জন দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের তৎকালীন উপমহাদেশের আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে দেখতে হবে। ১৭৫৭ সালের পলাশীর বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশ তথা উপ-মহাদেশ জুড়ে মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতি ও শিক্ষাক্ষেত্রে যে ঘোর অমানিশার অন্ধকার নেমে আসে তাতে মুসলমানদের স্বাধীন স্বত্তা হিসেবে মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকাই ছিল চরম দায়। এহেন পরিস্থিতিতে উপমহাদেশের মুসলমানদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আর্বিভূত হন স্যার সৈয়দ আহমদ, নবাব আবদুল লতিফ, ব্যারিস্টার আমীর আলী, নওয়াব মহসিন মুলক মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মাস্টার কাজেম আলী প্রমূখ। এ সব বিদগ্ধ জ্ঞানী মনিষীগণ বিশ্বাস করতেন মুসলিম জাতির হারানো শৌর্য-বীর্য পূণরুদ্ধারের একমাত্র উপায় হলো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। স্যার সৈয়দ আহমদ এর সাথে মাওলানা আবদুস সোবহান সাহেবের সাক্ষাত না হলেও তিনি ছিলেন তাঁর ভাবশিষ্য। অন্যান্যদের মত তিনিও বিশ্বাস করতেন আধুনিক শিক্ষা গ্রহন ছাড়া মুসলমানদের উত্তরণের বিকল্প কোন পথ নেই। ঐতিহাসিক দৃষ্টি সমীক্ষায় আজ একথা প্রমানিত সত্য যে, মাওলানা আবদুস সোবহান সাহেবের অশেষ ত্যাগ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের এক অনন্য ফসল ‘‘আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়’’ স্যার সৈয়দ আহমদ খান এর আলীগড় বিশ্ব বিদ্যালয়ের আদর্শিক সূত্রে গ্রথিত। আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পূর্বে ১৮৪৫ সালে একই স্থানে আরেকটি বিদ্যালয় থাকা সত্বেও স্থানীয় প্রেক্ষাপটে কেন মাওলানা সাহেব আরেকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন ইতিহাসের নিরিখে সেটিও বিচার্য বিষয়। যতদূর জানা যায় যে, বৃহত্তর পটিয়ায় সে সময় মুসলমানদের জন্য কোন আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলনা। যে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল সেটিতে মুসলমানদের ছেলেদের লেখাপড়া করার সুযোগ দেয়া হতো না। ফলে পশ্চাদপদ মুসলিম জনগোষ্ঠির সন্তানদের জন্য যুগপোযোগী শিক্ষার তাগিদে মাওলানা সাহেব তাঁর প্রতিষ্ঠিত সোবহানিয়া মক্তবকেই ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করেন। তার এই বৈপ্লবিক প্রয়াসে আর্থিক সহযোগিতা করেন পটিয়া থানার তৎকালীন দারোগা রাহাত আলী। কথিত আছে যে, মাওলানা সাহেবের প্রতিষ্ঠিত মক্তব রাতের অন্ধকারে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে পুঁড়িয়ে ফেলে। যতদূর জানা যায় যে, মুসলমান ছেলেদের শিক্ষার অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে বিধর্মীরা উক্ত মক্তব পুঁড়িয়ে দেয়। মক্তবের পাশে অবস্থিত থানায় গিয়ে বিষয়টি তিনি থানার তৎকালীন দারোগা রাহাত আলী সাহেবকে অবহিত করেন। রাহাত আলী সাহেব মাওলানা আবদুস সোবহান সাহেবের সাথে কথা বলে বুঝতে পারেন মাওলানা সাহেব মুসলিম জাতিকে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত। বিশেষ করে মুসলমান ছেলেমেয়েদের পড়া লেখা নিয়ে। রাহাত আলী দারোগা মাওলানা সাহেবের মধ্যে শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ দেখে তাঁকে মুসলমানদের উন্নতির জন্য মক্তবের পরিবর্তে আধুনিক ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব বুঝিয়ে বলেন। মাওলানা সাহেব আর্থিক অস্বচ্ছলতার কথা জানালে দারোগা রাহাত আলী সাহেব তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ১ হাজার টাকা প্রদান করেন। এভাবেই মাওলানা সাহেব প্রতিষ্ঠিত মক্তব হয়ে যায় আবদুস সোবহান ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়। রাহাত আলী সাহেব পটিয়া থানা থেকে বদলী হয়ে যাওয়ার পর ১৯১৭ সালে মাওলানা সাহেবের অনুরোধে তৎকালীন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রাহাত আলী দারোগার নাম অর্ন্তভুক্ত করে। তার পর থেকে অদ্যবধি বিদ্যালয়টি আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে।
রাহাত আলী দারোগার পরিচয় : ১৯১৪ সালে পটিয়া থানায় কর্মরত ছিলেন রাহাত আলী দারোগা। যতদূর জানা যায়, রাহাত আলী সাহেবের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায়। তিনি ছিলেন অকৃতদার। বিদ্যালয়ের শতবর্ষে পরে এসে তাঁর জম্ম ও মৃত্যু তারিখ সম্পর্কে বিদ্যালয়ে কোন রেকর্ড পত্র সংরক্ষন না থাকায় তাঁর সম্পর্কে বেশী কিছু জানা সম্ভব হয়নি।
প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি : ৩.৫ একর জায়গার উপর বর্তমানে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। বিদ্যালয়ের সামনে ও পিছনে রয়েছে দু’টি মাঠ। ৭ টি দ্বিতল ভবনের ২০ টি কক্ষে বিদ্যালয়ের শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য রয়েছে পৃথক ২টি ল্যাব কক্ষ, যেখানে রসায়ন ও জীব বিজ্ঞান হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য রয়েছে পৃথক কম্পিউটার ল্যাব। পাঠ্য বইয়ের বাইরে জ্ঞান অর্জনের জন্য রয়েছে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার কক্ষ। রয়েছে পৃথক অফিস কক্ষ। প্রধান শিক্ষকের জন্য রয়েছে সুবিশাল অফিস কক্ষ ও বিশ্রামাগার। শিক্ষকদের জন্য রয়েছে পৃথক কমন রুম। রয়েছে একটি নামায ঘর। বিদ্যালয়ের মাঝে পৃথক একটি অডিটোরিয়াম রয়েছে। যেখানে বছরব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রোগ্রাম। তবে ইচ্ছে করলে বাইরের লোকজনও শর্ত সাপেক্ষে ভাড়ার বিনিময়ে অডিটোরিয়াম ব্যবহার করতে পারেন। একটি পৃথক বিল্ডিং-এ রয়েছে ছাত্রদের জন্য একাধিক শৌচাগার।