আড়ানী মনোমোহিনী উচ্চ বিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রাচীনতম স্কুলগুলোর একটি । ১৫০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে স্বীয় ঐতিহ্যে আজও মহীয়ান । রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌরসভায় বড়াল নদীর তীরে এক মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত এ বিদ্যালয়টি। যুগে যুগে এ বিদ্যানিকেতনের সৃজিত কত বিদ্যান, কত গুনীজন ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বময় তার কোন হিসাব নেই ।
১৮৫৭ সালের বৃটিশ বিতাড়নের মহান সিপাহী বিপ্লবের ধ্বংশলীলার ৮ বছর পরে অর্থাৎ ১৮৬৫ সালে বর্তমান অবস্থানে পুঠিয়ার তদানিন্তন রাজা শ্রীযুক্ত পরেশ নারায়ণের জমিদারিতে ও অর্থানুকূল্যে মাটি ও খড়ের তৈরী আটচালা ঘরে স্কুলের যাত্রা শুরু হয় । তখন এ স্কুলের নামকরণ হয় ইংরেজিতে ‘RAJA PARESHNARAYAN AIDED VERNACULAR SCHOOL ' এবং বাংলায় তা ‘রাজা পরেশ নায়রায়ণ ’ সাহায্যকৃত বঙ্গবিদ্যালয় । ১৯৭৭ সালে বিদ্যালয়ের তৎকালীণ প্রধান শিক্ষক জনাব মুহঃ শেখ আলা-উদ-দীন সংস্কার ও পরিচ্ছন্নতা কাজের সময় আবর্জনার স্তুপের ভিতর থেকে একটি উপবৃত্তাকার পিতলের ফলক খুঁজে পান যার উপর বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নের এসব তথ্য খোদাই করা ছিল । এর পর প্রধান শিক্ষক মহোদয় বিদ্যালয়ের ইতিহাস সংগ্রহের ঐকান্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইতিহাস সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি সহায়তা নেন তাঁর পিতা মরহুম আমির আলী শেখ, তাঁর নানা মরহুম হাজী মসের উদ্দিনসহ মরহুম শ্রীযুক্ত শরৎ চন্দ্রদাস, মরহুম শ্রীযুক্ত পঞ্চানন কাব্যতীর্থ, আড়ানীর মহান বিপ্লবী বীর নেতা মরহুম শ্রী প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী মহাশয় প্রমুখ ব্যক্তিবর্গর । বাবু প্রভাস লাহিড়ী রচিত ‘আমার বিপ্লবী জীবন’ গ্রন্থ বিদ্যালয়ের ইতিহাস অনুসন্ধানে বিশেষগুরুত্ব রাখে। উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গর নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষনে অনুমান করা যায় যে, ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বর্ণিত বঙ্গবিদ্যালয়ের পাশে একটি মাটির দেয়ালসম্বলিত ঘর তুলে বিদ্যালয়টিকে Middle Vernacular School এ উন্নিত করা হয়। কয়েক বছর পর অর্থাৎ ১৯০৭-০৮ খ্রিষ্টাব্দে বড় পাঁচ কক্ষ বিশিষ্ট মাটির গাথুনি ও লোহার বীমযুক্ত এক বৃহৎ পাকা ভবন নির্মান করে বিদ্যালয়টিকে M.E.School এ রূপান্তরিত করা হয় ।
উল্লিখিত ভার্নাকুলার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মরহুম শ্রীযুক্ত বাবু রাম কান্ত চাকী এবং মিডল্ ভার্নাকুলার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রীযুক্ত বাবু উমেশ চন্দ্র অধিকারী, এফ, এ যিনি স্কুল পরিদর্শকের চাকুরি ত্যাগ করে এই বিদ্যালয়ের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন বলে জানা যায়। বিদ্যালয় পরিদর্শক মরহুম জনাব সোলায়মান সাহেবের পরামর্শে ও সহায়তায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সপ্তম শ্রেনী চালু করে এই বিদ্যালয়কে H.E. School-এ উন্নীত করার সূচনা করেন ।
শ্রীযুক্ত বাবু প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী M.E. School এর চতুর্থ শ্রেনীতে অধ্যয়ন কালের স্মৃতিচারনে তাঁর মহান গুরু শ্রী উমেশ চন্দ্র অধিকারী মহাশয়ের প্রশংসা করেছেন। এর পর পূবে-পশ্চিমে লম্বা বৃহৎ চারকক্ষ বিশিষ্ট টিনের ভবনটি নির্মান করা হয় এবং এটি নির্মানে পুঠিয়ার তৎকালীন রাজা মরহুম শ্রী নরেশ নারায়ণ ভূমি ও অর্থ সাহায্য করেন। তাঁর মাতা অর্থাৎ রাজা পরেশ নারায়ণের সহধর্মিনী রানী মনোমোহিনীর নামে স্কুলের নামকরণ করা হয় । H.E. School চালুর সময় প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন মরহুম শ্রীযু্ক্ত বাবু কুঞ্জ বিহারী সাহা। ১৯৯১ খ্রীষ্টাব্দের দিকে প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন ময়মনসিংহের অধিবাসী শ্রী জ্যোতীন্দ্র নাথ মৈত্র, বি, এ । এ বছরেই একদল ছাত্র প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স বা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক আড়ানী মনোমোহিনী উচ্চ বিদ্যালয় একটি ইংরেজী বিদ্যালয় হিসেবে স্থায়ী মঞ্জুরী লাভ করে এবং ছাত্ররা প্রথম নিয়মিত হিসেবে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ লাভ করেন। কলেরা রোগে শ্রী জ্যোতীন্দ্র নাথ মৈত্রের আকস্মিক মৃত্যু ঘটলে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দেই শ্রীযুক্ত বাবু রামকৃষ্ণ কুন্ডু বি, এ প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন এবং ১৯৫৭ সালে অবসর গ্রহণের পূর্বপর্যন্ত এ বিদ্যালয়ের সেবা করেন। তৎকালে রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি জেলা থেকে ছাত্ররা এসে এই বিদ্যালয়ে লেখা পড়া করেছেন। ১৯৩৯ সালে দীঘাপতিয়ার রাজা শ্রী বসন্তকুমারের আর্থিক সহায়তায় বর্তমান অফিসকক্ষ ও সংযুক্ত লাইব্রেরী ভবনটি নির্মিত হয় । ১৯৫৭ সালে বাবু রামকৃষ্ণ কুন্ডুর অবসর গ্রহণের পর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন জনাব আজের উদ্দীন, এম এ, বি, এড সাহেব। ১৯৬১-১৯৬২ সালে কিছু সরকারী উন্নয়ন মঞ্জুরী পাওয়া যায় যা দ্বারা ছাত্রাবাস, একটি শ্রেনী কক্ষ ও প্রয়োজনীয় কিছু আসবাবপত্র তৈরী করা হয়। ১৯৬৬ সালে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রদত্ত ৩,০০০.০০ টাকা, স্থানীয় ব্যবসায়ী আলহাজ্ব ভোলাই প্রামানিক প্রদত্ত ৫,০০০.০০ টাকা এবং শ্রীযুক্ত বাবু উমেশ চন্দ্র অধিকারী মহাশয়ের নাতি শ্রী প্রকাশ চন্দ্র চক্রবতী