কিংবদন্তী অনুযায়ী এটি বাংলাদেশের সবথেকে প্রাচীন দিঘি। নামে সাগর হলেও নীলসাগর আসলে এক বিশাল দীঘির নাম। চারিদিক নানা প্রজাতির গাছগাছালি ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত বিশাল এই দীঘিটি নীলফামারী জেলার প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। এটি আগে “বিন্না দিঘি” নামেই পরিচিত ছিল। এখানে প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সনাতন (হিন্দু) সম্প্রদায় বারুণী স্নান উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এর ব্যাপারে জনশ্রুতি ছিল যে এটি খুব পবিত্র দিঘি। কেউ যদি কোন কিছু আশা করে এই দিঘিতে দামী কোন বস্তু বিসর্জন দেয় তাহলে তার মনের আশা অবশ্যই পূরণ হবে। তাই অনেকের কাছেই এটি ছিল একটি পুণ্যস্থানের মর্যাদায় অভিষিক্ত।
একনজরে নীলসাগর:
নীলফামারী জেলা সদরের গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা মৌজায় ৫৩.৯০ একর জমির ওপর নীলসাগরের অবস্থান। এর জলভাগ ৩২.৭০ একর, এবং চারদিকের পাড়ের জমির পরিমাণ ২১ একরের মতো। নীলফামারী জেলা শহরের জিরো পয়েন্ট চৌরঙ্গী মোড় থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।
নামকরণ: কথিত আছে, অষ্টদশ শতাব্দীতে রাজার অগণিত গরু- মহিষের পানির চাহিদা মেটাতে প্রায় ৫৪ একর জমিতে খনন করা হয় দীঘিটি। মেয়ে বিন্নাবতীর নামানুসারে এর নাম দেওয়া হয় বিন্নাদীঘি। ১৯৭৮ সালে তত্কালীন মহকুমা প্রশাসকের উদ্যোগে এবং স্থানীয় ব্যক্তিদের মতামত অনুযায়ী বিন্নাদীঘির নাম পরিবর্তন করে 'নীলসাগর'নামকরণ করা হয়।
ইতিহাস:
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর কোন এক সময়ে এ জলাশয়টির খননকাজ শুরু হয়েছিল। নীল সাগর ‘বিরাট দিঘি’ ও 'বিন্না দিঘি' নামেও পরিচিত। হিন্দুশাস্ত্রমতে, খ্রিস্টপূর্ব নবম হতে অষ্টম শতাব্দীতে পান্ডবরা কৌরবদের চক্রান্তের শিকার হয়ে ১২ বছরের বনবাস ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হন এবং মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের রাজধানীর এ স্থানটিতে ছদ্মবেশে বসবাস শুরু করেন। মনে করা হয়, সেসময় নির্বাসিত পাণ্ডবদের তৃষ্ণা মেটাতে বৈদিক রাজা বিরাট এ দিঘিটি খনন করেছিলেন। বিরাট দিঘির অপভ্রংশ হিসেবে কালক্রমে এ দিঘিটি বিরাট দিঘি, বিল্টা দিঘি এবং অবশেষে বিন্না দিঘি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কারো কারো মতে, রাজা বিরাট তার বিশাল গরুর পালের জন্য পানির সংস্থান করতেই এ দিঘি খনন করেন এবং তার কন্যা বিন্নাবতীর নামে এর নামকরণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে নীলফামারীর তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ও অবসর প্রাপ্ত সচিব এম.এ জব্বার কর্তৃক এই দিঘিকে পর্যটনক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় ও নীলফামারীর নামানুসারে বিন্না দিঘির পরিবর্তে এর নামকরণ করা হয় নীলসাগর।
জনশ্রুতি:
জনশ্রুতি রয়েছে, ১৯৯৩ সালে সংস্কারের সময় দীঘির তলদেশে পাওয়া গিয়েছিল স্বর্ণ, রৌপ্য এবং কষ্টি পাথরের মূল্যবান মূর্তি। তবে মজার ব্যাপার হলো, মাটির তলদেশে মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও সেখানে বাস করতো বিশাল আকৃতির দুটি মাছ। কথিত আছে, এক সময় নাকি নীলসাগরের পানি শুকানোর জন্য অনেকগুলো মেশিন বসানো হয়েছিল। কিন্তু পানির উচ্চতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। লোকমুখে শোনা যায়, অতীতে গ্রামের লোকজন বিন্নাদীঘির পানিতে গাভীর প্রথম দুধ উত্সর্গ করতো। তাদের বিশ্বাস ছিল, এতে গাভীর দুধ বেশি হবে এবং অনিষ্টকারীর দৃষ্টি থেকে গাভীটি রক্ষা পাবে।
নীলসাগরের আকর্ষণ:
নীলসাগরের বিশাল দীঘির চারদিকে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ-গাছালির সমাহার। পানি আর সবুজ মিলে সৃষ্টি হয় এক অপরূপ নৈশর্গিক দৃশ্যের। ছায়াঘেরা দীঘির চারপাশ বাঁধানো। শান বাঁধানো দীঘির চারপ্রান্তে রয়েছে সিঁড়ি। দীঘির পাড়ে পাকা রাস্তার কিছুদূর পর পর দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে সুদৃশ্য বিশ্রামাগার, ছাতাসহ বসার স্থান। এখানে শিশুদের জন্য দোলনা, নাগরদোলারও ব্যবস্থা রয়েছে। শীতকালে সাইবেরিয়াসহ শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে আসা অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। এটিই মূলত নীলসাগরের প্রধান আকর্ষণ। মাঝপুকুরে বসে ভিনদেশি হাজার পাখির মেলা। দীঘিতে ফোটা শাপলার ফাঁকে ফাঁকে পাখির জলকেলি প্রকৃতিতে যোগ করে ভিন্ন মাত্রা। প্রকৃতির সেই অপূর্ব সৌন্দর্য্য দেখতে শীতকালে এখানে ছুটে আসেন নানা বয়সী মানুষ। কল্পকাহিনী ঘেরা নীলসাগরে প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বসে মেলা। প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়া পেতে নীলফামারীর মানুষ ছাড়াও ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর ও দিনাজপুরসহ আশেপাশের জেলাগুলো থেকেও বিপুল সংখ্যক মানুষ অবসরে এখানে ছুটে আসে।