সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষ তার ঐতিহ্যকে লালন করে এগিয়ে চলছে। সৃষ্টি করেছে নতুন নতুন সংস্কৃতি, ধর্ম এবং জীবন প্রণালী। স্বতন্ত্র এই আবহ নিয়েই বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আবির্ভাব হয় বরেন্দ্র জনপদের। যা সমগ্র ভারত উপমহাদেশে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আর কার্যক্রমের মাধ্যমে তার পরিচয় ধরে রেখেছিল। পাঁচবিবি উপজেলা এই বরেন্দ্র জনপদেরই একটি অঞ্চল।
আজকের পুন্ড্র নগর (মহাস্থান) তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে যেমন আড়াই হাজার বছর আগের সভ্যতার ঐতিহ্য রয়েছে ঠিক তেমনি পাঁচবিবির ভূ-খন্ডে অন্তত দুই হাজার বছরের পুরানো ইতিহাসের চিহ্ন রয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। খ্রীষ্টিয় প্রথম - দ্বিতীয় শতকে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়া পঞ্চনগরী ইতিহাস থেকে শুরু করে প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়ে প্রথম মহিপাল পর্যন্ত একটি শক্ত প্রশাসনিক নগর পত্তন হয় এবং এরপরেও মুসলিম বিজয়ের মাধ্যমে এলাকাকে আলোচিত হয়ে ওঠে।
রাজশাহী বিভাগের উত্তরের সর্বশেষ জেলা জয়পুরহাট, জেলা সদর থেকে দশ কিলোমিটার উত্তরে আবস্থান পাঁচবিবি উপজেলার। ১৮৬৮ সালে সৃষ্ট তৎকালিন এই থানাটি বৃহত্তর বগুড়ার অংশ বিশেষ ছিল যার আয়তন ২৭৮.৫৩ বর্গ কিলোমিটার। সমগ্র উপজেলার মধ্যে বেশ কিছু বিস্তৃত স্থান রয়েছে যা ঐতিহাসিক ভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন অঞ্চলের বেশির ভাগ প্রত্নস্থান অত্র উপজেলার আটাপুর ইউনিয়নে পরেছে। উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এই ইউনিয়ন। পুরো ইউনিয়নের বেশ অংশ জুড়ে এই প্রত্নস্থান। ইউনিয়নের মাঝ বরাবর পাঁচবিবি-ঘোড়াঘাট সড়ক এবং প্রত্নস্থান সমূহের পাশ দিয়ে প্রাচীণ তুলশীগঙ্গা নদী বয়ে গেছে।
বিশেষ উল্লেখযোগ্য স্থান সমূহ; নাসিরউদ্দিন শাহ্ (নিমাই পিরের) দরগাহ, প্রথম পাথরের সেতু, নওপুকুরিয়া, উচাই কসবা, কাসিয়াবাড়ির ধাপ, বাদের ধাপ/ দরগাহ, মহীপাল রাজার বাড়ি, মহীপুরের মহীপাল রাজার সমাধি বা নীলকুঠির মত ঐতিহাসিক জায়গা।
তুলশীগঙ্গা নদীটি পাথরঘাটার কাছাকাছি এসে দুটি ক্ষুদ্র নদীতে বিভক্ত হয়। পাথরঘাটার দুই পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কিছু দক্ষিণে গিয়ে আবার একত্রে মিলিত হয়েছে। এই পাথরঘাটা - মহিপুর সমগ্র অঞ্চলটি প্রায় ২৫-৩০ বর্গ কিলোমিটারের চেয়েও বেশী। যার পুরো অঞ্চল একটি প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে বিবেচিত।
বিভিন্ন সময়ের পর্যবেক্ষণ এবং বিশিষ্ট ঐতিহাসিকগণের বর্ণনা থেকে পাথরঘাটা - মহিপুর অঞ্চল নিয়ে যে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা আসে তার সার সংক্ষেপ থেকে বলা যায়, অন্যতম প্রাচীণ রাজধানী মহাস্থানগড় অঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত এই পাথরঘাটার গোড়াপত্তন হয় সম্ভবত মৌর্য যুগের শেষ দিকে। পরে আরো সুবিন্যস্তভাবে জেগে ওঠে ভারতের কূষাণ রাজবংশের সময়ে। তখনই এই পাথরঘাটা অঞ্চলটি প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে প্রকাশ পায়। যক্ষ মূর্তি, পাথরের সেতু এবং পঞ্চনগরীর মতো বিষয় সমূহ এই সময়ে আওতাভুক্ত হয়। খুব সম্ভব এর কিছু সময়ের পর গুপ্ত যুগে 'কুমারমভতা কুলবৃদ্ধি' উপাধী নিয়ে পাথরঘাটায় পঞ্চনগরী বিশেষ একটি স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীতে প্রথম মহিপাল এসে রাজধানী স্থাপন করার ফলে পাল যুগে আবারো জায়গাটি আলোচিত হয়। এবং ধারণা করা হয় যে সেন রাজবংশ সময়ে কিছু কাল যথেষ্ট নাগরিক সুবিধা সহ নগরটি বেঁচে ছিল। পরবর্তীতে মুসলিম বিজয়ে অত্র বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন রাজ্য কাঠামোর ধারাবহিকতার ছোঁয়া এখানেও পড়ে। এবং সেই সময়েই আসেন পীর হযরত নাসিরউদ্দিন নিমাই শাহ্ (র:)। তিঁনি ধ্বংস প্রাপ্ত এলাকাটিতে নতুন নাগরিক জীবনের বীজ বপন করেন।