রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রংপুর
সুপ্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য,শিক্ষা ও সংস্কৃতির অধিকারী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি বিশিষ্ট জনপদ রংপুর। অসংখ্য শিক্ষানুরাগী, বিদ্যোৎসাহী, জ্ঞানীগুণী, খ্যাতনামা কবি সাহিত্যিক এবং অগণিত বরেণ্য আলোক উদ্ভাসিত ব্যক্তিবর্গের অন্যতম পাদপীঠ রংপুর, প্রকৃতপক্ষে একটি ঐতিহ্যমন্ডিত স্থান। রংপুর এবং এর নিকটবর্তী জমিদারগণের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাসখ্যাত ও ঐতিহ্য খচিত এই শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী ও স্বনামখ্যাত বিদ্যাপীঠ রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। বৃটিশ আমলে বিদ্যালয়টির নাম ছিল রংপুর বালিকা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়। ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় এক শতাব্দীর বেশি সময় আগে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত ও পথিকৃত মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার নারী শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রমের আগেই এই বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছিল। সম্ভবতঃ রংপুর সদরে এটাই মেয়েদের জন্য স্থাপিত প্রথম বিদ্যালয়। পুর্বে এই বিদ্যালয়টি একটি ছোট মাইনর স্কুল ছিল। ডিমলার জমিদার জানকীবল্লভ স্ত্রী শিক্ষার প্রসারতার কথা চিন্তা করেই বিদ্যালটি নির্মাণ করেছিলেন। ওবিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি দেওয়ানবাড়ির জমিদার জনাব রাধারমন দেওয়ানজীর অম্লান পরিশ্রম ও অক্লান্ত প্রচেষ্ঠায় ১৮৭৬ সালে বিদ্যালটির প্রথমিক স্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। ডিমলার জমিদার জানকীবল্লভ ১৮৮৬ সালে বিদ্যালয়টিকে প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত করেন। মোট ৩.৬৪ একর জমির ওপর এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত। ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয় হিসেবে বেসরকারিভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। পরবর্তী সময়ে সারা দেশের জেলা সদরের প্রাচীনতম স্কুল ও কলেজ সরকারীকরণ কার্যক্রমের আওতায় ১৯৬১ সালে বিদ্যালয়টি সরকারীকরণ করা হয়।
চারদিকে সীমানা প্রাচীর পরিবেষ্টিত বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বাহারী গাছপালার অপূর্ব সমারোহ ও ফুলে ফলে সবুজে শ্যামলে সুশোভিত অনিন্দ্য সুন্দর মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই শুধু নয় বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রথিতযশা, নিবেদিত প্রাণ, অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী বিদ্যালয়টির গৌরব ও সুনামকে সমুন্নত রেখেছেন।
শিক্ষাকার্যক্রমের পাশাপাশি স্থানীয় উন্নয়নেও বিদ্যালয়টি যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। দূর্নীতি দমন, স্বাক্ষরতা অভিযান কর্মসূচী, বৃক্ষরোপণ, যে কোন মারাত্মক সংক্রামিত রোগব্যাধি সম্পর্কে অবহিতকরণ ও গণসচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহনের মাধ্যমে বিদ্যালয়টি স্থানীয় উন্নয়নে সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা, শিশু একাডেমী, গণিত অলিম্পিয়াড, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রসহ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অংশ গ্রহন করে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে তাদের গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখছে।
যেকোন প্রাকৃতিক দূর্যোগে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ ও নগদ অর্থ সাহায্য প্রদান করে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ ও শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে থাকে। এছাড়া গরীব মেধাবী ও অসুস্থ শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান, দরিদ্র কল্যাণ তহবিল থেকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বিদ্যালয় অনন্য ভূমিকা পালন করছে।
১৯৯১ সালে সরকার বিদ্যালয়টিতে ডাবল শিফট চালু করে। এর ফলে একই অবকাঠামো ব্যবহার করে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীর পড়াশুনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
জনাব ফরিদা ইয়াসমীনের (প্রধান শিক্ষক) পরিচালনায় ৫৩জন অভিজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ৯জন কর্মচারীর সমন্বয়ে বিদ্যালয়টির সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
সময় ও চাহিদার প্রতি দৃকপাত করে বিদ্যালয়টির অবকাঠামোগত সম্প্রসারণ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও তা যথেষ্ট নয়। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে জরাজীর্ণ ভবনটি ১৯৬১ সালে নির্মিত। বিদ্যালয়ের মূল ভবনটি ২০০১সাল পর্যন্ত ‘কালের কপোলতলে শুভ সমুজ্জ্বল’ হয়ে বিদ্যালয়ের প্রাচীনত্বকে ধারণ করে দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে তা ব্যবহারের অযোগ্য হওয়ায় কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে পরিত্যক্ত ভবনটি অপসারণ করা হয়। এখন রয়েছে একটি টিনসেডের মূল ভবন, এবং একটি দ্বিতল ও একটি তিনতলা একাডেমিক ভবন, একটি রসায়ন ল্যাবরেটরি ভবন। বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত দুরের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ৬০ আসন বিশিষ্ট একটি ছাত্রীনিবাস। এই অবকাঠামো নিয়েই সময় ও যুগের চাহিদার সাথে মিল রেখে এগিয়ে চলছে বিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম।
২০১৫ সালে ২০৬৬ জন শিক্ষার্থী অত্র বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছে। তবে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর তুলনায় শ্রেণি কক্ষের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। বিদ্যালয়টিতে কোন অডিটরিয়াম না থাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা কষ্টকর হয়ে পরে। ছাত্রী পরিবহনের জন্য বড় বাসেরও অভাব বিদ্যমান। এসব সমস্যা ও সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারলেই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টি শিক্ষার মান উন্নয়নে আরো প্রশংসনীয় ও আলোকিত অবদান রাখতে পারবে বলে আমাদের সকলেরই দৃঢ় প্রত্যয়।